ইলেকট্রিক যানবাহন (EV) প্রযুক্তির উন্নয়ন আমাদের জীবনে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। পরিবেশ দূষণ কমানো এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যানবাহন শিল্পে একটি বড় বিপ্লব ঘটেছে। তবে ইলেকট্রিক গাড়ি (EV) কেনার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল এর সীমিত রেঞ্জ বা একবার চার্জে কতদূর চলতে পারবে। এর সমাধান হিসাবে গবেষকরা সম্প্রতি নতুন ধরনের এক বিপ্লবী ব্যাটারি প্রযুক্তির ওপর কাজ করছেন, যাকে বলা হচ্ছে কার্বন ফাইবার ভিত্তিক ওজনহীন ব্যাটারি। এই নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি ইলেকট্রিক যানবাহনের রেঞ্জ ৭০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।
কার্বন ফাইবার ব্যাটারি প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
কার্বন ফাইবার ব্যাটারি মূলত এক ধরনের স্ট্রাকচারাল ব্যাটারি যা ইলেকট্রিক যানবাহন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য ওজনহীন কাঠামো সরবরাহ করে। এই ব্যাটারি প্রযুক্তির লক্ষ্য হল গাড়ির কাঠামোতে ব্যাটারি সংযুক্ত করা, ফলে ব্যাটারি আলাদাভাবে লাগানোর প্রয়োজন হয় না। এর ফলে গাড়ির মোট ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, এবং ব্যাটারির শক্তি সঞ্চয় ক্ষমতা বেড়ে যায়।
কার্বন ফাইবার কীভাবে কাজ করে?
কার্বন ফাইবার ব্যাটারি দুটি প্রধান উপাদান দিয়ে তৈরি – কার্বন ফাইবার এবং লিথিয়াম আয়ন। এই কার্বন ফাইবার গাড়ির স্ট্রাকচারের অংশ হিসাবে কাজ করে, যা একদিকে শক্তি সঞ্চয় করে এবং অন্যদিকে গাড়ির লোড বহন করে। এর ফলে, গাড়ির ওজন হ্রাস পায় এবং শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
আরো পড়ুন: দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিবে ইলন মাস্ক এর নিউরালিংকের ব্লাইন্ডসাইট ইমপ্ল্যান্ট
ওজনহীন প্রযুক্তির ধারণা
“ওজনহীন” শব্দটি এখানে মূলত ব্যাটারির ওজন কমিয়ে গাড়ির মোট ওজন কমানোর উদ্দেশ্য নির্দেশ করে। কার্বন ফাইবার ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে, গাড়ির কাঠামোর সঙ্গে ব্যাটারি সরাসরি একীভূত করা সম্ভব, ফলে গাড়ির বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে ব্যাটারির জন্য জায়গা করার প্রয়োজন হয় না।
ইলেকট্রিক গাড়ির রেঞ্জ বৃদ্ধির সম্ভাবনা
এই বিপ্লবী ব্যাটারি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল ইলেকট্রিক গাড়ির রেঞ্জ বৃদ্ধি করা। প্রচলিত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির চেয়ে এই কার্বন ফাইবার ব্যাটারি অনেক বেশি শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে। গবেষকদের মতে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেকট্রিক গাড়ির রেঞ্জ ৭০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
স্ট্রাকচারাল ব্যাটারি প্রযুক্তির উদ্ভাবন
এই স্ট্রাকচারাল ব্যাটারি প্রযুক্তির পেছনে গবেষণা অনেক বছর ধরে চলেছে, বিশেষ করে চালমার্স ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো গবেষকরা দেখিয়েছিলেন কীভাবে কার্বন ফাইবার শক্তিশালী স্ট্রাকচারাল উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে এবং একসঙ্গে শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে। এর ফলে, ব্যাটারির ওজন কমিয়ে ইলেকট্রিক যানবাহনের রেঞ্জ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়।
ব্যাটারির শক্তি সঞ্চয় ক্ষমতা বৃদ্ধি
এই নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির আগের মডেলগুলোর চেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চয় ক্ষমতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে গবেষকরা এই প্রযুক্তির ব্যাটারির শক্তি ঘনত্ব ২৪ ওয়াট-ঘণ্টা/কিলোগ্রাম (Wh/kg) ছিল, যা একক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে এটি ৩০ Wh/kg পর্যন্ত বেড়েছে।
প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
এটি বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ হতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে, তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ইন্ডাস্ট্রি উভয়ই এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। চালমার্স ইউনিভার্সিটি এর গবেষকরা এই ব্যাটারি প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে নতুন উদ্যোগের জন্য কাজ করছেন। তারা আশা করছেন যে কয়েক বছরের মধ্যে ইলেকট্রিক যানবাহন এবং অন্যান্য ডিভাইসগুলোতে এই কার্বন ফাইবার ব্যাটারি প্রযুক্তি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হবে।
পরিবেশের ওপর প্রভাব
এই কার্বন ফাইবার ভিত্তিক ব্যাটারি প্রযুক্তি পরিবেশের জন্যও বেশ উপকারী হতে পারে। ইলেকট্রিক যানবাহনের ওজন কমিয়ে এবং শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি করে, এটি শক্তির ব্যবহার কমাতে সহায়ক হবে, যা পরিবেশগত দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
শিল্পে প্রযুক্তির সম্ভাবনা
অটোমোটিভ, এভিয়েশন, এবং এনার্জি ইন্ডাস্ট্রিতে এই নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির প্রভাব বড় হতে পারে। বিশেষ করে অটোমোটিভ শিল্প এবং এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি এ ইলেকট্রিক যানবাহনগুলোর ওজন কমানো এবং দীর্ঘ রেঞ্জ প্রদান করার জন্য এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, কার্বন ফাইবার ব্যাটারি প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সাফল্য শুধুমাত্র ইলেকট্রিক যানবাহনের ক্ষেত্রে নয়, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসেও এর ব্যবহার সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে আমরা আরও লাইটওয়েট এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যাটারি প্রযুক্তি দেখতে পাব, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।
কার্বন ফাইবার ভিত্তিক এই নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি যানবাহন এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর রেঞ্জ এবং কার্যক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেবে। এটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের একটি বড় মাইলফলক নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক যানবাহন এবং অন্যান্য ডিভাইসগুলো আরও কার্যকর, পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী হবে।