নাসার ইন্সপেক্টর জেনারেলের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)-এ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি ফুটো (ছিদ্র) সমস্যার ওপর নতুন কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার PrK মডিউলে প্রথমবারের মতো একটি ফুটো ধরা পড়ে, যা প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র হলেও সময়ের সাথে সাথে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। PrK মডিউলটি রাশিয়ার Zvezda মডিউলকে একটি ডকিং পোর্টের সঙ্গে সংযুক্তকারী একটি টানেল। ফুটো হওয়ার কারণে এই অংশে বায়ুমণ্ডল প্রতিনিয়ত বেরিয়ে যাচ্ছে, যা আইএসএস পরিচালনার জন্য একটি গুরুতর ঝুঁকি হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ফুটোর হার বছরের পর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আইএসএস প্রতিদিন ১ পাউন্ডেরও কম বায়ু হারাচ্ছিল। তবে, মার্চ মাসে এই হার বেড়ে প্রায় ২.৪ পাউন্ডে পৌঁছায় এবং এপ্রিলের মধ্যে তা ৩.৭ পাউন্ডে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, প্রতিদিন প্রায় ৩.৭ পাউন্ড বায়ুমণ্ডল বের হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই পরিমাণ বায়ু ক্ষতি আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে, তবে এটি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে মহাকাশ স্টেশনের নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে নতুন ‘GHOST SHARK’ আবিষ্কার করেছেন
এই ফুটো সমস্যা নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থাগুলো একসাথে কাজ করছে। তবে, এখন পর্যন্ত এই সমস্যার মূল কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নাসার ইন্সপেক্টর জেনারেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সংস্থা ফুটো হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত ওয়েল্ড বা সংযোগস্থলগুলোকে সন্দেহ করছে। যদিও এটি PrK মডিউলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে পুরো স্টেশনের কার্যক্রম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
নাসার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থায় এই সমস্যাটি ৫x৫ ঝুঁকি ম্যাট্রিক্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা কোনো সমস্যার সম্ভাব্যতা এবং এর পরিণতি মূল্যায়ন করে। ফুটো সমস্যা এখন উচ্চ সম্ভাব্যতা এবং উচ্চ পরিণতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই কারণেই নাসা এটিকে সর্বোচ্চ স্তরের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছে। যদিও রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থাগুলো এটিকে সমাধানের জন্য কাজ করছে, এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালের মে এবং জুন মাসে নাসা এবং রোসকসমোসের কর্মকর্তারা এই ফুটো সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনায় মিলিত হন। নাসার মতে, রোসকসমোস আত্মবিশ্বাসী যে তারা ফুটোর হার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে এবং এটি বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছানোর আগেই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তবে, নাসা এবং রোসকসমোসের মধ্যে এখনো কোনো নির্দিষ্ট সমঝোতা হয়নি যে কখন ফুটোর হার এত বৃদ্ধি পেতে পারে যে তা গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
আইএসএসের জন্য এই ফুটো সমস্যাটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ নয়, এটি মহাকাশ স্টেশনের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি প্রায় ২৫ বছর পুরনো, এবং এর বেশ কয়েকটি অংশ এখন বয়সজনিত কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা এবং রাশিয়া উভয়ই ২০২৮ সাল পর্যন্ত স্টেশনটি পরিচালনার চুক্তি করেছে, এবং নাসা ২০৩০ সাল পর্যন্ত এর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চায়। তবে, ফুটো সমস্যাটি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে PrK মডিউলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এতে করে স্টেশনের রাশিয়ান অংশে ডকিং পোর্টের সংখ্যা কমে চার থেকে তিনে নেমে আসবে। এর ফলে স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ এবং কার্যক্রম পরিচালনা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
এদিকে, নাসা এই ফুটো সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা কমানোর চেষ্টা করছে। সংস্থাটি বলছে যে, সমস্যাটি শুধুমাত্র PrK মডিউলের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং এখন পর্যন্ত এটি স্টেশনের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে, নাসার ঝুঁকি মূল্যায়ন অনুযায়ী, পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যেতে পারে যদি ফুটো সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণে আনা না হয়। যদি এই ফুটো মডিউলটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে স্টেশনের কার্যক্রমে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে মহাকাশচারীদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে, বিশেষ করে যেহেতু মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে একটি দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে।
নাসা এবং রোসকসমোসের মধ্যে ঝুঁকি নিরসনে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও তারা উভয়ই ফুটো সমস্যার ওপর নজর রাখছে এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। নাসা আশা করছে যে তারা রাশিয়ার সহায়তায় এই ফুটো সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তবে, নাসা এবং রোসকসমোস উভয়ই মহাকাশ স্টেশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নন।
আইএসএস–এর ভবিষ্যৎ পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নাসা ইতোমধ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্থাটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত স্টেশনটি চালু রাখতে চায় এবং আশা করছে যে নতুন প্রযুক্তি ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে স্টেশনের কার্যক্ষমতা বাড়ানো যাবে। তবে, এই ফুটো সমস্যার সমাধান না হলে স্টেশনটির কার্যক্রম এবং ভবিষ্যত নিয়ে একটি বড় অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। মহাকাশ স্টেশনটির প্রায় ২৫ বছরের ইতিহাসে এটি একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তাছাড়া, এই সমস্যার সমাধান না হলে অন্যান্য মডিউলগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন অংশে সময়ের সাথে সাথে ক্ষয় দেখা দিতে পারে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, মহাকাশ স্টেশনটি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে নাসা এবং রোসকসমোসের এই সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মহাকাশ স্টেশনটির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া এবং এর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সফল করতে হলে উভয় সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ফুটো সমস্যার পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা মহাকাশ স্টেশনটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাইছেন। মহাকাশ স্টেশনটির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে এবং এর মাধ্যমে মহাকাশ অভিযানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হলে, এসব চ্যালেঞ্জ সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।