পারমাণবিক বোমা: কি, কেন ও কিভাবে?

পারমাণবিক বোমা পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম ধ্বংসাত্মক এবং বিতর্কিত আবিষ্কার। এর প্রাথমিক উদ্ভাবন এবং এর কার্যকারিতা মানুষকে শঙ্কিত করেছে এবং রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে এর ব্যবহার অনেক বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাব এবং ব্যবহার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, তবে এর পিছনের বিজ্ঞান এবং ইতিহাস আমাদের বোঝা জরুরি। এই প্রবন্ধে, আমরা পারমাণবিক বোমার ইতিহাস, প্রযুক্তি, এবং এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পারমাণবিক বোমা কী ?

পারমাণবিক বোমা হলো একটি শক্তিশালী অস্ত্র যা পরমাণুর বিভাজন বা সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে শক্তি মুক্তি করে। এই প্রক্রিয়াটি “নিউক্লিয়ার ফিশন” (নিউক্লিয়ার বিভাজন) এবং “নিউক্লিয়ার ফিউশন” (নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ) নামে পরিচিত। পরমাণুর নিউক্লিয়াস যখন বিভাজিত হয় বা একত্রিত হয়, তখন বিশাল শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি এতটাই প্রবল যে এটি বিস্ফোরিত হলে একটি বড় এলাকার জীবন ও পরিবেশের উপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে।

আরো পড়ুনঃ পারমাণবিক শক্তি: কি, কেন ও কিভাবে?

পারমাণবিক বোমার শক্তির ৎস কী

পারমাণবিক বোমার শক্তির মূল উৎস হলো নিউক্লিয়ার ফিশন এবং নিউক্লিয়ার ফিউশন। এই প্রক্রিয়াগুলোতে পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয় বা একত্রিত হয়, যার ফলে প্রচুর শক্তি নির্গত হয়। ফিশন প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে, আর ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুটি হালকা পরমাণু একত্রিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তি এতটাই প্রবল যে এটি মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করতে পারে। শক্তির এই উৎসের কারণে পারমাণবিক বোমা পৃথিবীর সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্রগুলোর একটি।

পারমাণবিক বোমা কে আবিষ্কার করেছিলেন ?

পারমাণবিক বোমার উদ্ভাবন মূলত একটি বড় বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ছিল, যা ম্যানহাটন প্রজেক্ট নামে পরিচিত। তবে প্রধান আবিষ্কারক হিসেবে রবার্ট ওপেনহাইমারের নাম উল্লেখযোগ্য। রবার্ট ওপেনহাইমারকে “পারমাণবিক বোমার জনক” বলা হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হয়। ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা ফিশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এই বিপ্লবী অস্ত্র তৈরি করেন। তবে এককভাবে তাকে এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া ঠিক হবে না, কারণ অনেক বিজ্ঞানীর মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই এই বিপ্লবী আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। যেমন, আলবার্ট আইনস্টাইন তার বিখ্যাত সূত্র E=mc² এর মাধ্যমে শক্তির ধারণা প্রদান করেন, যা ফিশন প্রক্রিয়ার ভিত্তি তৈরি করে। এনরিকো ফের্মি এবং লিও সিলার্ড এর মত বিজ্ঞানীরাও পারমাণবিক চুল্লির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

পারমাণবিক বোমা কী দিয়ে তৈরি ?

পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে প্রধানত দুটি উপাদান ব্যবহৃত হয়: ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং প্লুটোনিয়াম-২৩৯। তবে এর সাথে আরো কিছু উপাদান এবং যন্ত্রাংশও প্রয়োজন হয়, যেমন:

  • নিউট্রন সূচককারী: এটি নিউট্রনকে প্রাথমিক ফিশন প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে।
  • তরল বা কঠিন বিস্ফোরক: এটি প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিশন প্রক্রিয়া শুরু করে।
  • ধাতব খোল: এটি বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং শক্তি নির্গত করে।

বোমার নকশা এবং এর কাজের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আরও বিভিন্ন উপাদান ব্যবহৃত হতে পারে।

জৈব প্রযুক্তি কি? মানব জীবনে এর প্রভাব

পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রধান উপাদান

পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে মূলত দুটি উপাদান প্রয়োজন: ইউরেনিয়াম-২৩৫ (Uranium-235) এবং প্লুটোনিয়াম-২৩৯ (Plutonium-239)। এ দুটি উপাদানই নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করে। নিচে এই উপাদানগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো:

  1. ইউরেনিয়াম-২৩৫ (Uranium-235): ইউরেনিয়াম হলো একটি ভারী ধাতু, যা সাধারণত পারমাণবিক ফিশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি নিউক্লিয়াসে নিউট্রন শোষণ করলে বিভাজিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। বোমার জন্য ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম অবশ্যই উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ হতে হবে, যাতে এর ফিশন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়।
  2. প্লুটোনিয়াম-২৩৯ (Plutonium-239): প্লুটোনিয়াম একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি উপাদান যা নিউক্লিয়ার ফিশনের মাধ্যমে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করে। প্লুটোনিয়াম প্রাথমিকভাবে পরমাণু চুল্লিতে তৈরি করা হয় এবং বোমার শক্তি বৃদ্ধি করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

পারমাণবিক বোমা কিভাবে কাজ করে ?

পারমাণবিক বোমার কাজের প্রক্রিয়া দুটি প্রধান ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়: নিউক্লিয়ার ফিশন এবং নিউক্লিয়ার ফিউশন।

  1. নিউক্লিয়ার ফিশন: এই প্রক্রিয়ায় ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয়, যা তাকে দুটি ছোট অংশে বিভাজিত করে। এই বিভাজন প্রক্রিয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। পারমাণবিক বোমার মূল নীতি হলো এই ফিশন প্রক্রিয়াকে একটি চেইন রিয়াকশনে পরিণত করা, যা একের পর এক পরমাণুকে বিভাজিত করে শক্তি উৎপন্ন করে।
  2. নিউক্লিয়ার ফিউশন: ফিউশন হলো দুটি হালকা পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একত্রিত করে একটি ভারী পরমাণু তৈরি করার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ফিশনের চেয়ে আরও বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়। হাইড্রোজেন বোমা বা “থার্মোনিউক্লিয়ার” বোমা এই ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে।

পারমাণবিক বোমার ক্ষমতা কত ?

পারমাণবিক বোমার ক্ষমতা সাধারণত “টন” বা “মেগাটন” দ্বারা পরিমাপ করা হয়, যা TNT বিস্ফোরকের সমতুল্য শক্তি নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার ক্ষমতা ছিল প্রায় ১৫ কিলোটন, অর্থাৎ এটি ১৫,০০০ টন TNT বিস্ফোরকের সমান শক্তি উৎপন্ন করেছিল। আধুনিক পারমাণবিক বোমাগুলো প্রায় ১০০ কিলোটন থেকে শুরু করে কয়েক মেগাটন পর্যন্ত শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাগুলো আরও বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম, যা সাধারণ ফিশন বোমার তুলনায় অনেক বেশি বিধ্বংসী।

আরো পড়ুনঃ প্রসেসর কি? মোবাইল ও কম্পিউটার প্রসেসরের মধ্যে পার্থক্য

পারমাণবিক বোমা কোন দেশে কতটি ?

বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। এই দেশগুলোকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বলা হয়। নিচে কয়েকটি প্রধান পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংখ্যা উল্লেখ করা হলো (২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী):

  • যুক্তরাষ্ট্র: প্রায় ৫,৫৫০ টি পারমাণবিক অস্ত্র।
  • রাশিয়া: প্রায় ৬,২৫০ টি।
  • চীন: প্রায় ৩৫০ টি।
  • ফ্রান্স: প্রায় ২৯০ টি।
  • যুক্তরাজ্য: প্রায় ২২৫ টি।
  • ভারত: প্রায় ১৬০ টি।
  • পাকিস্তান: প্রায় ১৬৫ টি।
  • উত্তর কোরিয়া: প্রায় ৪০-৫০ টি।
  • ইসরায়েল: আনুমানিক ৮০-৯০ টি (ইসরায়েল কখনো তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা প্রকাশ করেনি)।

এই সংখ্যাগুলো প্রায়ই পরিবর্তিত হয়, কারণ দেশগুলো তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার আপডেট করে বা নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা চালায়।

পারমাণবিক বোমা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিপ্লবী এবং ধ্বংসাত্মক আবিষ্কার। যদিও এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল, তবে এর পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে এটি একটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। পারমাণবিক বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা যেমন মানবজাতির জন্য হুমকি, তেমনই এর সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার বিশ্বে স্থিতিশীলতা আনতে পারে। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি জরুরি যে আমরা পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখি এবং এর বিধ্বংসী দিক থেকে আমাদের রক্ষা করতে সক্ষম হই।

 

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো