সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের তলদেশের নীচে এবং জলতাপীয় ছিদ্রের (hydrothermal vents) নিকটে অবস্থিত ছোট ছোট গুহায় প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল যে শুধুমাত্র মাইক্রোবস (microbes) এবং ভাইরাসগুলোই এমন প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু এই গবেষণা জানাচ্ছে, সেখানে বৃহৎ প্রাণীও বসবাস করছে। এই গবেষণায় আবিষ্কৃত প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশালাকার কৃমি, সামুদ্রিক শামুক এবং বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক কৃমি, যা আগে কখনোই এতটা গভীরে পাওয়া যায়নি।
গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ছিদ্রগুলো কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে এই অঞ্চলের প্রাণীরা সেখানে বসবাস করে, তা সবসময়ই একটি রহস্য ছিল। পূর্ববর্তী গবেষণায় মাইক্রোস্কোপিক জীবাণু পাওয়া গেলেও এবার বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বৃহত্তর প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন, যা এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করে।
জলতাপীয় ছিদ্রগুলো এমন একটি স্থান যেখানে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো মিলিত হয় এবং সমুদ্রের পানি মাটির নীচের ম্যাগমার সঙ্গে মিশ্রিত হয়। এখানে তাপমাত্রা অত্যন্ত উচ্চ এবং চাপও বিপুল। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করতেন যে এই ধরনের পরিবেশে বড় প্রাণী বসবাস করতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক এই গবেষণা প্রমাণ করে যে সমুদ্রের তলদেশ এবং এর নীচের ছোট গুহাগুলোতে জীবন ব্যস্ত রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বিজ্ঞানীরা আর্কটিক সমুদ্রতলে রহস্যময় এক বরফের কাঠামো আবিষ্কার করেছেন
প্রায় ৮,২৫০ ফুট গভীরতার একটি জলতাপীয় ছিদ্রের কাছে চালানো এক গবেষণায়, গবেষকরা বিশালাকার কৃমি এবং সামুদ্রিক শামুক খুঁজে পেয়েছেন, যা পূর্বে কেবলমাত্র ছিদ্রের উপরিভাগে পাওয়া যেত। বিশেষত, টিউবওয়ার্ম এবং অন্যান্য প্রাণীদের গুহার ভেতরে বাস করার বিষয়টি বড় একটি আবিষ্কার। এই গুহাগুলো প্রায় চার ইঞ্চি গভীর, যেখানে উষ্ণ পানি এবং ম্যাগমা মিশ্রিত থাকে। এখানে এমন প্রাণী পাওয়া গেছে, যারা শুধুমাত্র উপরের অংশে সীমাবদ্ধ না থেকে গুহার অভ্যন্তরেও বসবাস করে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, টিউবওয়ার্ম এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা শুধুমাত্র উপরের স্তরে নয়, বরং সমুদ্রের তলদেশের ভেতরেও প্রজনন করতে পারে। গবেষকরা গুহার ভেতরে পুরুষ এবং স্ত্রী টিউবওয়ার্মের প্রজনন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করেছেন, যেখানে পুরুষ টিউবওয়ার্মের শুক্রাণুযুক্ত টেস্টিস এবং স্ত্রী টিউবওয়ার্মের ডিম্বাণুযুক্ত গোনাড ছিল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, সমুদ্রের তলদেশের গুহাগুলো শুধুমাত্র আবাসস্থল নয়, বরং প্রজননের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে কাজ করে।
এই প্রজাতির লার্ভা গুহার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কিছু গর্তে বসতি স্থাপন করতে পারে। আবার, কিছু গুহার ভেতরেই অবস্থান করে পূর্ণাঙ্গ হতে পারে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে সমুদ্রের উপরিভাগ এবং তলদেশের গুহাগুলো একটি অভিন্ন বাস্তুতন্ত্র গঠন করে, যেখানে শীতল এবং উষ্ণ জল প্রবাহ মিশে প্রাণীর বৃদ্ধি ঘটায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, জলতাপীয় ছিদ্রের এই অঞ্চল শুধুমাত্র উপরের অংশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর নিচেও একটি জীববৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এই বাস্তুতন্ত্রে প্রচুর প্রাণীর জীবনযাপন রয়েছে, যা এতদিন অজানা ছিল।
এই ধরনের গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীরা আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ গভীর সমুদ্রের খনিজ সম্পদ নিষ্কাশনের পরিকল্পনা এই বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, গভীর সমুদ্রের এই বাস্তুতন্ত্র কতটা বিস্তৃত এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আগে থেকে বোঝা উচিত, যাতে এগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
বিজ্ঞানীরা আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই ধরনের বাস্তুতন্ত্র পৃথিবীর বাইরের অন্যান্য জগতে জীবনের অস্তিত্ব বুঝতে সাহায্য করতে পারে। যেমন, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় একটি বরফের নিচে মহাসাগর রয়েছে, যেখানে হাইড্রোথার্মাল ছিদ্রের মতো জীববৈচিত্র্য থাকতে পারে।
নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে নতুন ‘Ghost Shark’ আবিষ্কার করেছেন