আকাশের নক্ষত্র বৃষ্টির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ওরিয়নিড উল্কাপাত, যা প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে আমাদের চোখে পড়ে। এটি হ্যালির ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশের সাথে সম্পর্কিত, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে উল্কা সৃষ্টি করে। প্রতি বছর এই উল্কাপাত আমাদের আকর্ষণ করে কারণ এটি অন্যতম প্রধান এবং বিশ্বস্ত উল্কাপাত গুলোর মধ্যে একটি। যদিও ২০২৪ সালের ওরিয়নিড উল্কাপাত কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে চলেছে, তবুও এটি মহাকাশপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় দৃশ্য হতে পারে।
ওরিয়নিড উল্কাপাতের বৈশিষ্ট্য
ওরিয়নিড উল্কাপাত সাধারণত অক্টোবর মাসের ১৬ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে ঘটে এবং এর সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায় ২১ অক্টোবর রাতের শেষ দিকে বা ২২ অক্টোবর ভোরবেলায়। এক ঘন্টার মধ্যে প্রায় ২০টি উল্কাপাত দেখতে পাওয়া যায়, তবে এ বছর চাঁদের উজ্জ্বল আলো সেই সংখ্যাকে কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। যদিও এই উল্কাপাত পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে দেখা যায়, কিন্তু এর সর্বোচ্চ পিকের সময়েই সবচেয়ে বেশি উল্কা দেখা সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে আঘাতকারী উল্কাপিন্ডের রহস্যময় উত্স উন্মোচন করেছেন
এটি ‘ওরিয়নিড’ নামকরণ করা হয়েছে কারণ এই উল্কাগুলি মূলত ওরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলের একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে উদ্ভাসিত হয়। বিশেষ করে, উল্কাগুলি ওরিয়নের বিখ্যাত লাল তারকা বেটেলগিউজের কাছাকাছি থেকে বের হয় বলে মনে হয়। ওরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলকে আমরা পৃথিবীর আকাশে দেখতে পাই মধ্যরাতের পর থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত, এবং উল্কাপাতের সবচেয়ে ভালো দৃশ্য দেখা যায় যখন ওরিয়ন আকাশের মধ্য-দক্ষিণ অংশে অবস্থান করে। এই উল্কাপাত উত্তরের ও দক্ষিণের উভয় গোলার্ধ থেকেই প্রায় সমানভাবে দেখা যায়, যা এটিকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে।
উল্কাপাতের গতি এবং হ্যালির ধূমকেতুর প্রভাব
ওরিয়নিড উল্কাগুলি অত্যন্ত দ্রুতগামী, প্রায় ৬৬ কিমি/সেকেন্ড গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। এগুলি মূলত ধূলিকণা বা বালুকণার আকারের ক্ষুদ্র কণা, যা হ্যালির ধূমকেতুর দ্বারা পৃথিবীর কক্ষপথে ছেড়ে যায়। এই ধূমকেতু প্রায় প্রতি ৭৬ বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং এর কিছু অংশ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে উল্কাপাত সৃষ্টি করে। ফলে, প্রতিবার ওরিয়নিড উল্কাপাত দেখা গেলে এটি যেন হ্যালির ধূমকেতুর একটি ক্ষুদ্র ঝলক দেখতে পাওয়ার সুযোগ।
হ্যালির ধূমকেতু সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে পৃথিবীর কাছাকাছি এসেছিল এবং পরবর্তীতে এটি ২০৬১ সালে আবার ফিরে আসবে। যদিও আমরা সরাসরি ধূমকেতুটিকে দেখতে পাব না, তবে এই উল্কাপাতের মাধ্যমে তার অবশিষ্টাংশের ঝলক দেখতে পারি।
আরও পড়ুনঃ চীন ২০৫০ সালের মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য পরিকল্পনা করেছে
এবারের পর্যবেক্ষণ চ্যালেঞ্জ
যদিও ২০২৪ সালের ওরিয়নিড উল্কাপাত বিশেষ আকর্ষণীয়, তবে এবারের চাঁদের উজ্জ্বলতা বড় একটি বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে। ২১ অক্টোবর ভোরবেলায় চাঁদ প্রায় ৮০% আলোকিত থাকবে এবং আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলবে, যা উল্কাপাত দেখার জন্য ক্ষতিকর। অনেক উল্কা চাঁদের আলোতে মুছে যেতে পারে, তবে তবুও কিছু উজ্জ্বল উল্কা চোখে পড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ওরিয়নিড উল্কাগুলি অন্য উল্কাগুলোর তুলনায় অনেক দীর্ঘ সময় ধরে আকাশে একটি আলোর রেখা রেখে যায়।
কোথায় এবং কিভাবে দেখবেন
ওরিয়নিড উল্কাপাত দেখতে চাইলে কিছু বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। প্রথমত, শহরের আলো থেকে দূরে গিয়ে কোন নিরাপদ ও অন্ধকার এলাকা বেছে নিতে হবে। শহরের দূষিত আলোর কারণে অনেক উল্কা দেখা সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য ধরে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। উল্কাপাত যেকোনো দিক থেকে আসতে পারে, তবে ওরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলের দিকে তাকালে সবচেয়ে ভালোভাবে উল্কাপাত লক্ষ্য করা যাবে।
এছাড়া, চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি অন্ধকারে মানিয়ে নিতে সময় লাগে, তাই মোবাইল ফোনের আলো এড়িয়ে চলা উচিত। চোখকে অন্ধকারের সাথে অভ্যস্ত হতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। তাছাড়া, উল্কাপাত দেখার জন্য টেলিস্কোপ বা দূরবীন ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ এতে দৃশ্যটি সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং পুরো আকাশ দেখা যায় না।
উল্কাপাতের বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য
উল্কাপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যেখানে ক্ষুদ্র বস্তুকণা বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণের ফলে জ্বলতে থাকে এবং আকাশে আলোর রেখা সৃষ্টি করে। এগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় তীব্র তাপের কারণে সাদা আলো উৎপন্ন করে। এই ঘটনাকে সাধারণত আমরা “শুটিং স্টার” বা “তারা খসা” বলে অভিহিত করি। ওরিয়নিড উল্কাপাত মূলত হ্যালির ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশের অংশ এবং এটি আমাদের সূর্যের কক্ষপথে অবস্থান করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে।
এই উল্কাগুলি যখন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন তা এতটাই গরম হয়ে যায় যে এগুলি সাদা আলোতে জ্বলে উঠে এবং আকাশে একটি উজ্জ্বল রেখা তৈরি করে। এতে আমাদের কাছে মনে হয় তারা আকাশ থেকে খসে পড়ছে। তবে বাস্তবে, এগুলি ক্ষুদ্র কণার সাথে বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট আলোকরেখা।
নাসা চাঁদের মিশনে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে ৩ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা করেছে