বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল ডেটার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, যা বিদ্যমান ডেটা সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, ক্লাউড স্টোরেজের চাহিদা এবং বড় ডেটার প্রয়োজনীয়তার জন্য প্রচুর পরিমাণে ডেটা সেন্টার স্থাপন হচ্ছে, যা অনেক বিদ্যুৎ খরচ করছে এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ডিএনএ-কে ডেটা সংরক্ষণের একটি নতুন মাধ্যম হিসেবে পরীক্ষা করছেন, কারণ ডিএনএ তার অসাধারণ স্থায়িত্ব এবং বিপুল ক্ষমতার কারণে বড় পরিসরে ডেটা সংরক্ষণ করতে সক্ষম।
ডিএনএ স্টোরেজ কিভাবে কাজ করে ?
ডিএনএ হলো প্রকৃতির এক ধরনের তথ্য সংরক্ষণকারী, যা হাজার হাজার বছর ধরে জীবনের মূল তথ্য সংরক্ষণ করে আসছে। বিজ্ঞানীরা এই জিনগত কোডকে (genetic code) কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ডিএনএতে তথ্য এনকোড করা সম্ভব এবং এটি প্রচলিত হার্ড ড্রাইভের তুলনায় অনেক ছোট এবং টেকসই। ডিএনএর মাত্র এক গ্রাম প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘন্টার HD ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম, যা অনেকটাই অবিশ্বাস্য এবং বর্তমানে বিদ্যমান যেকোনো স্টোরেজ ডিভাইসের তুলনায় অসাধারণ।
আরও পড়ুনঃ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পিতৃপরিচয় কিভাবে নিশ্চিত করা যায়?
ডিএনএতে তথ্য সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি: মিথাইলেশন
গবেষকরা ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ডিএনএ-র বেসগুলোকে পরিবর্তন করে ০ এবং ১-এ রূপান্তর করে। এই পদ্ধতিটি সাধারণত মিথাইলেশন (Methylation) নামে পরিচিত, যা ডিএনএর বিভিন্ন অবস্থানকে ০ অথবা ১ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এটি কম্পিউটারের বাইনারি সিস্টেমের মতো, যেখানে ০ এবং ১ দ্বারা তথ্য ধারণ করা হয়। গবেষকরা এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডিএনএতে দ্রুত এবং সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এটি অনেক বেশি দ্রুত এবং কম খরচে কার্যকর।
চলমান সংকট এবং ডিএনএ স্টোরেজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
প্রচলিত হার্ড ড্রাইভ বা মেমোরি স্টোরেজ ডিভাইসগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার অক্ষমতা এবং উচ্চ খরচ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধি এবং প্রতিদিনের ডেটা সংগ্রহ বৃদ্ধির কারণে বড় ডেটা সংরক্ষণ করার জন্য ব্যাপক পরিমাণে বিদ্যুৎ এবং খরচের প্রয়োজন পড়ছে। প্রথাগত স্টোরেজ প্রযুক্তিগুলো দীর্ঘমেয়াদি ডেটা সংরক্ষণ এবং বিদ্যুৎ খরচ কমানোর ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। ডিএনএকে একটি বিকল্প হিসেবে নিয়ে আসার কারণ হলো এটি খুব ছোট, স্থিতিশীল এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম, যা ভবিষ্যতের জন্য পরিবেশবান্ধব একটি সমাধান হতে পারে।
মুদ্রণ প্রযুক্তির সাথে তুলনীয় ডিএনএ স্টোরেজের নতুন পদ্ধতি
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিকে মুদ্রণ প্রযুক্তির সাথে তুলনা করেছেন। প্রচলিত ডিএনএ এনকোডিং পদ্ধতিগুলো অনেকটা তথ্যকে দড়ির সাথে গিঁট দেওয়ার মতো জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ছিল, কিন্তু এই নতুন পদ্ধতি সেই সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করে অনেকটা মুদ্রণ প্রক্রিয়ার মতো সহজ ও দ্রুত করেছে। প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় এটি ১০ হাজার গুণ দ্রুত এবং খরচও অনেক কম। গবেষকদের মতে, এই পদ্ধতি “প্রিন্টিং প্রেস” এর মতো কাজ করে, যেখানে বিভিন্ন ডিএনএ বেস বা বেস কেমিক্যালগুলোকে ব্যবহার করে দ্রুত তথ্য প্রক্রিয়া করা সম্ভব। মিথাইলেশন পদ্ধতির সরলতা এবং দ্রুততা ডিএনএ এনকোডিং পদ্ধতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বড় ডেটা সংরক্ষণে ডিএনএর ব্যবহারিক সুবিধা
ডিএনএ ডেটা স্টোরেজের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে এটি দীর্ঘ সময় ধরে বড় পরিসরে ডেটা সংরক্ষণ করতে সক্ষম। এই পদ্ধতিতে একবার ডিএনএ-তে ডেটা এনকোড করা হলে, এটি খুব সহজেই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকে এবং কোনো ধরনের বড় রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই সংরক্ষিত থাকে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিতে চিত্র, পাঠ্য এবং অন্যান্য জটিল তথ্য ডিএনএতে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তা পরে সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান
ডিএনএ স্টোরেজ বিদ্যমান হার্ড ড্রাইভের তুলনায় কম বিদ্যুৎ খরচ করে, যা পরিবেশের উপর প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমান সময়ে বড় বড় ডেটা সেন্টারগুলোর জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণ করার মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। এটি শুধুমাত্র সাশ্রয়ী নয়, বরং পরিবেশের উপরও ভালো প্রভাব ফেলবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশকে সহায়তা করবে, কারণ এটি বিদ্যমান পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ খরচ করে।
ডিএনএ ডেটা স্টোরেজের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ
যদিও ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণে অনেক সুবিধা রয়েছে, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই পদ্ধতিতে ডেটা পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। বর্তমানে গবেষকরা ডিএনএ-র মিথাইলেশন পদ্ধতির স্থায়িত্ব এবং এর ওপর বিভিন্ন অবস্থার প্রভাব পরীক্ষা করছেন। ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণের প্রাথমিক খরচ এখনও বেশ বেশি এবং প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় এর ব্যবহারিক দিকেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে গবেষকরা আশা করছেন যে ভবিষ্যতে এর খরচ কমবে এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ আরও প্রসারিত হবে।
ডিএনএ স্টোরেজ সম্ভাব্য ব্যবহারিক প্রয়োগ
ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণের জন্য অনেক ধরনের ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত ডেটা থেকে শুরু করে কর্পোরেট ডেটা, এমনকি জাতীয় ডেটা সংরক্ষণেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতে পারে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ডেটা সুরক্ষা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব, কারণ ডিএনএতে এনকোড করা তথ্য পুনরুদ্ধার করতে বিশেষ প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়, যা সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য নয়। ফলে, ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণের মাধ্যমে সুরক্ষিত ও দীর্ঘমেয়াদী তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
ডিএনএ স্টোরেজ একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথ
ডিএনএতে ডেটা সংরক্ষণের এই নতুন পদ্ধতি কেবল বড় ডেটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, বরং এটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্যও সহায়ক হতে পারে। যেহেতু ডিএনএ-র মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের জন্য ডেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব, তাই এটি পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী সমাধান হিসেবে কাজে লাগবে। গবেষকরা এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতে এর ব্যবহারিক প্রয়োগের আরও অনেক সুযোগ তৈরি হবে।
তথ্য সূত্রঃ এফটি