যুক্তরাষ্ট্রের এবং কলোরাডো উটাহ অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের সম্প্রতি করা এক আশ্চর্য আবিষ্কার আমাদেরকে ৭২ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর কী অবস্থা ছিল তার একটি কাল্পনিক ধারনা দিতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ-কলোরাডো সীমান্তের কাছ থেকে পাওয়া এক নতুন স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম এই আবিষ্কারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই প্রাণীটি তখনকার একটি জলাভূমি অঞ্চল, যা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ছিল, সেখানে বসবাস করত। বিজ্ঞানীরা এই নতুন প্রজাতিটির নাম দিয়েছেন “Heleocola piceanus”, যার অর্থ লাতিন ভাষায় “জলাভূমির বাসিন্দা”। এই নামটি প্রাণীর বাসস্থান সম্পর্কে নির্দেশ করে, যেখানে প্রাণীটি নদী এবং জলাভূমির আশেপাশে বসবাস করত।
এই আবিষ্কারটি মূলত একটি ফসিলাইজড দাঁত ও চোয়াল থেকে হয়েছিল, যা ২০১৬ সালে র্যাঞ্জলি, কলোরাডোর এক বালুকাপাথরের ব্লকে পাওয়া যায়। যদিও পাথরে কচ্ছপের খোলের টুকরো দৃশ্যমান ছিল, কিন্তু Heleocola সম্পর্কে ধারণা তখন করা যায়নি। পাথর প্রস্তুত করার সময় ২০১৮ সালে এক স্বেচ্ছাসেবক ফসিলের এক অদ্ভুত সেট আবিষ্কার করেন। জীবাশ্মগুলো বিশ্লেষণ করার পরে, বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি, যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুনঃ সমুদ্রের তলদেশে নতুন প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলো বিজ্ঞানীরা
বিশাল আকারের পূর্ববর্তী স্তন্যপায়ী
Heleocola-এর ফসিল বিশেষভাবে আগ্রহের কারণ ছিল এর দাঁতের আকার। সাধারণত এই সময়ের স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর দাঁত ছোট, চিপমাংকের আকারের মতো হতো। কিন্তু Heleocola-এর দাঁত ছিল প্রায় পাঁচগুণ বড়, যা বিজ্ঞানীদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই প্রাণীটির ওজন প্রায় ২ পাউন্ড ছিল, এবং এটি বর্তমান সময়ের মার্সুপিয়াল প্রজাতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
এই বিশাল আকারের স্তন্যপায়ীটি ৭০ থেকে ৭৫ মিলিয়ন বছর আগে উত্তর আমেরিকার এক বিশাল জলাভূমিতে বসবাস করত। সেই সময়ে এই অঞ্চলটি আজকের লুইজিয়ানার মিসিসিপি নদীর ডেল্টার মতো ছিল, যেখানে জলাভূমির আশেপাশে বিভিন্ন প্রাণী যেমন হাঙর, রে এবং গিটারফিশের মতো জলজ প্রাণী বাস করত। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সেই সময়ের পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পারছেন।
নতুন প্রজাতি: Heleocola piceanus
বিজ্ঞানীরা Heleocola-এর নাম দিয়েছেন “swamp dweller” বা জলাভূমির বাসিন্দা। ধারণা করা হয়, এটি মূলত উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য খেত, তবে মাঝেমধ্যে পোকামাকড় বা ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণীও খেত। অধ্যাপক জেলিন এবারলে, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী, যিনি এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন, তিনি বলেন, “দাঁতের গঠন দেখে আমরা ধারণা করতে পারি, এটি উদ্ভিদভিত্তিক খাবার খেত, কিন্তু মাঝে মাঝে ছোট প্রাণীও খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে।”Heleocola আকারে বড় ছিল, এবং এটি দেখে বোঝা যায়, তখনকার সময়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বড় আকারের হতে পারত।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিকাশ এবং জীবাশ্মের গুরুত্ব
প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে, একটি বিশাল গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়, এবং তারপরে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা দ্রুত বিবর্তিত হয়ে বড় আকার ধারণ করতে শুরু করে। Heleocola-এর আবিষ্কারটি প্রমাণ করে যে, ডাইনোসরদের বিলুপ্তির আগেই কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী আকারে বড় হতে শুরু করেছিল, যা আগের ধারণাগুলোর বিপরীত। এই নতুন ফসিলটি আমাদেরকে একটি বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীর ইঙ্গিত দেয়, যা তৎকালীন সময়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ীদের তুলনায় অনেক বড় ছিল।
বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য
এই নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, জলাভূমি অঞ্চলে সে সময় বহু প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল, এবং বাস্তুতন্ত্রটি ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। বিজ্ঞানী জন ফস্টার, যিনি এই গবেষণার সহ-লেখক, তিনি বলেন, “এই ডেল্টা অঞ্চলে স্থলে ও পানিতে অসংখ্য প্রাণীর বাস ছিল। এই আবিষ্কার আমাদের সেই সময়ের প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়ক হবে।”
এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন উত্তর আমেরিকার পরিবেশ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। বিশেষ করে ৭২ মিলিয়ন বছর আগের জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেখানে বাস করা প্রাণীদের সম্পর্কে।
ফসিল সংগ্রহ
বিজ্ঞানীরা আগামীতে আরও গভীরভাবে গবেষণা করতে চান Heleocola piceanus-এর জীবনযাপন এবং বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে। এর মতো প্রাচীন প্রাণীর জীবাশ্মগুলো আমাদেরকে পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রদান করে এবং আমরা বুঝতে পারি কিভাবে সময়ের সাথে সাথে প্রাণীরা বিবর্তিত হয়েছে।
গবেষকরা এই ফসিলের মাধ্যমে প্রাচীন প্রাণীদের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে তাদের সংযোগ স্থাপন করতে চান এবং আরও ফসিলের সন্ধান করতে চান, যা আমাদেরকে সেই সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে আরও গভীর তথ্য প্রদান করবে।