নরওয়ের ইতিহাসের একটি পুরোনো এবং রহস্যময় অধ্যায় আবারও আলোচনায় এসেছে, যখন মধ্যযুগীয় এক ব্যক্তির কঙ্কাল এবং নর্স সাহিত্যের একটি সাগা একে অপরের সাথে জুড়ে গেছে। সম্প্রতি, নরওয়ের স্ভেরেসবোর্গ দুর্গে পাওয়া একটি কূপে প্রাপ্ত কঙ্কাল বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই কঙ্কালের সূত্রপাত ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে, যা নর্স রাজা স্ভেরে সিগুর্দসনের শাসনামলের সময়কালে ঘটে যাওয়া একটি সামরিক আক্রমণের সময়ের।
গবেষণায় প্রথমবারের মতো আধুনিক ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং রেডিওকার্বন ডেটিং ব্যবহার করা হয়। এটি প্রকাশিত হয় ‘iScience’ জার্নালে, যা নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। গবেষণাটি মাইকেল মার্টিনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, যিনি নরওয়ের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিবর্তনবিজ্ঞানী। তিনি জানান, এটি হয়তো প্রথম উদাহরণ যেখানে একটি নর্স সাগার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিকে সনাক্ত করা গেছে।
আরও পড়ুনঃ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পিতৃপরিচয় কিভাবে নিশ্চিত করা যায়?
‘স্ভেরিস সাগা’ নামে পরিচিত এই নর্স সাগাটি নরওয়ের প্রাচীন রাজা স্ভেরে সিগুর্দসনের জীবন ও রাজত্বকে কেন্দ্র করে রচিত। এই সাগায় উল্লেখ আছে, ‘বাগলার’ নামে এক বিরোধী গোষ্ঠী স্ভেরে সিগুর্দসনের দুর্গে আক্রমণ চালায় এবং কূপে এক মৃতদেহ নিক্ষেপ করে। এই দেহ ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল পানির উৎস দূষিত করা এবং দুর্গকে বাসযোগ্যহীন করে তোলা। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, এই ঘটনা সম্ভবত রাজা স্ভেরে নিজে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন এবং তাঁর শাসনকাল (১১৭৭-১২০২ খ্রিস্টাব্দ) নিয়ে লিখিত এই কাহিনি একপ্রকার প্রাচীন ‘প্রচার’ হিসেবে কাজ করত।
গবেষকদের গবেষণায় কঙ্কালটির ডিএনএ এবং তার আবাসিক অঞ্চল সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষভাবে, কঙ্কালটির প্রাপ্তির পরে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে নতুন কিছু অংশ আবিষ্কৃত হয়, যার মধ্যে ছিল কঙ্কালটির মাথার খুলি এবং এক হাতে থাকা কিছু অংশ। বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, কঙ্কালটির বয়স ছিল প্রায় ৩০-৪০ বছর। মাথার খুলিতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা ধারণা করা হচ্ছে জীবনের শেষ মুহূর্তে পাওয়া ছিল।
কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্যটি আসে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, যেখানে জানা যায় যে ব্যক্তিটির পূর্বপুরুষরা সম্ভবত দক্ষিণ নরওয়ের আগদের অঞ্চলের ছিল। এটি একটি চমকপ্রদ বিষয়, কারণ স্ভেরির সামরিক বাহিনী মূলত মধ্য নরওয়ের মানুষ ছিল। এটি একটি ধারণা তৈরি করে যে হয়তো বাগলাররা তাদের নিজস্ব সৈন্যদের মধ্যে কেউ কূপে নিক্ষেপ করেছিল। এই গবেষণার মাধ্যমে নরওয়ের মধ্যযুগীয় সামরিক সংঘাতের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
গবেষকরা ‘ওয়েল-ম্যান’ নামে চিহ্নিত এই ব্যক্তির চেহারার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছেন। ডিএনএ বিশ্লেষণে জানা গেছে, তার চোখের রং নীল এবং চুলের রং ছিল হালকা বাদামি বা সোনালি। এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঐতিহাসিক নরওয়ের মানুষের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে গবেষকরা ওয়েল-ম্যান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে সক্ষম হন এবং প্রমাণিত হয় যে প্রাচীন কাহিনিতে উল্লিখিত কূপের দেহটি সত্যিই ঐ সময়ের একজন মানুষকে নির্দেশ করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে আঘাতকারী উল্কাপিন্ডের রহস্যময় উত্স উন্মোচন করেছেন
গবেষণার সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। গবেষকদের মতে, একক একটি ঐতিহাসিক উৎসের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ সত্য উদঘাটন করা কঠিন। তারা কেবল একটি দাঁতের ওপর ভিত্তি করে জেনোম বিশ্লেষণ করেছেন, কারণ এর বাইরের অংশ দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এছাড়া, প্রাপ্ত কঙ্কালের সব অংশ একসাথে না থাকায় এবং বিভিন্ন অংশ পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়ায় বৈজ্ঞানিক ফলাফলগুলোতে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
‘স্ভেরিস সাগা’র মতো প্রাচীন সাহিত্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা গেলে, প্রাচীন নর্স ইতিহাসের অনেক রহস্য উদ্ঘাটন হতে পারে। এই ধরনের গবেষণা শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করতেই নয়, বরং প্রাচীন সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সংমিশ্রণ ঘটাতে সহায়ক। বিজ্ঞান এবং সাহিত্য, বিশেষ করে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাচীন কাহিনি ও ইতিহাসকে আরো পরিস্কার ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বোঝা সম্ভব।
তথ্য সূত্রঃ সিএনএন