মহাবিশ্বের জটিল গঠন এবং পদার্থবিদ্যার বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলে আসছে। এর মধ্যে ডার্ক ম্যাটার বা অন্ধকার পদার্থের পরিচয় খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। ডার্ক ম্যাটার এমন এক রহস্যময় পদার্থ, যা আলোর মাধ্যমে দৃশ্যমান নয়, কিন্তু মহাকর্ষীয় প্রভাবে তার উপস্থিতি বোঝা যায়। বৈজ্ঞানিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে যে, একটি বিশেষ কণা—অ্যাক্সিয়ন—এই ডার্ক ম্যাটারের জন্য দায়ী হতে পারে। আর এই অ্যাক্সিয়ন কণাগুলির উৎপত্তিস্থল হতে পারে নিউট্রন তারা, যা মহাবিশ্বের অন্যতম ঘন এবং শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে।
নিউট্রন তারা এবং তাদের চুম্বক ক্ষেত্র
নিউট্রন তারাগুলি প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ তারার সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর অবশিষ্ট থাকে। এই বিস্ফোরণের পর তারার কেন্দ্রীভূত অবশিষ্টাংশ এতটাই ঘন এবং তীব্র চুম্বক ক্ষেত্রযুক্ত যে এটিকে নিউট্রন তারা বলা হয়। এই তারাগুলি পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা নিউট্রন এবং প্রোটনকে সংকুচিত করে একটি বিরল ঘনতা তৈরি করে। নিউট্রন তারাগুলির মধ্যে আরও একটি বিশেষ ধরণের তারা রয়েছে, যাকে ‘পালসার’ বলা হয়। পালসার অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঘূর্ণায়মান হয় এবং এদের চুম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। এই চুম্বকীয় শক্তি অনেক ক্ষেত্রে অ্যাক্সিয়ন কণাগুলির আলোক রূপান্তরের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ টোকিও বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কার, কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে ফর্মেট জ্বালানি তৈরি
অ্যাক্সিয়ন কণার ভূমিকা এবং ধারণা
১৯৭০ এর দশকে অ্যাক্সিয়নের ধারণা প্রথম উঠে আসে, যেখানে বিজ্ঞানীরা নিউট্রনের বৈশিষ্ট্যের কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে এটি প্রস্তাব করেন। তাত্ত্বিকভাবে ধারণা করা হয়, অ্যাক্সিয়ন কণাগুলি ডার্ক ম্যাটার হিসেবে কাজ করতে পারে এবং মহাবিশ্বে দৃশ্যমান পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই মহাকর্ষের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে পারে। অ্যাক্সিয়নের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারলে আমরা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বও নির্ধারণ করতে পারি, যা মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% অংশজুড়ে রয়েছে।
নিউট্রন তারা এবং অ্যাক্সিয়ন কণার সম্ভাব্য রূপান্তর
বিজ্ঞানীদের ধারণা, নিউট্রন তারার চুম্বক ক্ষেত্র এতটাই শক্তিশালী যে এটি অ্যাক্সিয়ন কণাগুলিকে আলোর ফোটনে রূপান্তর করতে পারে। একে বলা হয় ‘প্রিমাকফ এফেক্ট’। যখন অ্যাক্সিয়ন একটি চুম্বক ক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসে, তখন এটি ফোটনে পরিণত হতে পারে, যা একে দৃশ্যমান করার একটি সুযোগ দেয়। গবেষকরা মনে করছেন যে, নিউট্রন তারাগুলির আশেপাশে অ্যাক্সিয়ন কণাগুলির ঘনত্ব তৈরি হতে পারে, যা অ্যাক্সিয়ন ক্লাউড নামে পরিচিত।
অ্যাক্সিয়ন শনাক্তকরণ: চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
যদিও নিউট্রন তারার আশেপাশে অ্যাক্সিয়ন কণাগুলি শনাক্তকরণে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে বিজ্ঞানীরা এর জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করছেন। এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, নিউট্রন তারাগুলির চুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে অ্যাক্সিয়ন কণাগুলি পালসারের চেয়ে সামান্য বেশি উজ্জ্বল হতে পারে, যা একটি সম্ভাব্য ইঙ্গিত হতে পারে। তবে এ পর্যন্ত করা গবেষণায় এই অতিরিক্ত আলো পাওয়া যায়নি, যা ধারণা করছে যে অ্যাক্সিয়ন কণার বৈশিষ্ট্যের জন্য আরও সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যতে স্পেস-ভিত্তিক রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে নিউট্রন তারাগুলির কাছাকাছি অ্যাক্সিয়নের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা সম্ভব হতে পারে। কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর বাধা সৃষ্টি করে, যা স্পেস-ভিত্তিক টেলিস্কোপে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
স্পেস–ভিত্তিক পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব
বর্তমান পর্যবেক্ষণ সরঞ্জামগুলির মধ্যে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবং ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপ উল্লেখযোগ্য, তবে এগুলি ইর ইনফ্রারেড এবং নিকট-ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে। স্পেসে একটি রেডিও টেলিস্কোপ স্থাপন করলে এটি অ্যাক্সিয়ন কণাগুলির উপস্থিতি শনাক্ত করতে আরও কার্যকর হতে পারে। বিজ্ঞানীরা লুনার ক্রেটার রেডিও টেলিস্কোপ নামক একটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন, যা চাঁদের পৃষ্ঠে স্থাপন করে অন্ধকার প্রান্তের গর্তে স্থাপিত হবে। এই টেলিস্কোপটি মহাকাশে দীর্ঘ তরঙ্গের আলোক কণাগুলির সন্ধানে বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে, যা অ্যাক্সিয়নের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে সহায়ক।
গবেষণার ভবিষ্যৎ
বর্তমান গবেষণাগুলি মহাবিশ্বের কিছু প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কণার সন্ধান প্রদানে নতুন এক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। নিউট্রন তারার মতো চরম চুম্বক ক্ষেত্রযুক্ত স্থানে অ্যাক্সিয়নের উপস্থিতি শনাক্ত করার মাধ্যমে আমরা ডার্ক ম্যাটারের গঠন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও বিশদে জানতে পারব। এই গবেষণাগুলি বিজ্ঞানীদের আরও উন্নত পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম এবং আরও শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করার জন্য উৎসাহিত করছে, যা ভবিষ্যতে অ্যাক্সিয়নের অস্তিত্ব নির্ণয়ে সহায়ক হবে।
অ্যাক্সিয়ন কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করা আমাদের মহাবিশ্বের গঠন এবং ডার্ক ম্যাটারের রহস্য উদঘাটনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। নিউট্রন তারার মতো শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্রযুক্ত স্থানে এই কণাগুলির সন্ধান করা আমাদেরকে এই রহস্যময় কণাগুলির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে। স্পেস-ভিত্তিক রেডিও টেলিস্কোপ এবং উন্নত পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা অ্যাক্সিয়নের অস্তিত্ব এবং এর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করতে পারলে মহাবিশ্বের অমীমাংসিত অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হবে।