রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখানে উন্নত প্রযুক্তির প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। তবে ভারতের একটি ঔষধ কোম্পানি, শ্রেয়া লাইফ সায়েন্সেস, এমন এক বিতর্কিত ভূমিকা পালন করছে, যা রাশিয়ার কাছে উন্নত প্রযুক্তির সরবরাহ অব্যাহত রাখার সুযোগ দিচ্ছে। ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, মুম্বাই ভিত্তিক এই কোম্পানি ডেলের পাওয়ারএজ XE9680 সার্ভার রাশিয়ায় রপ্তানি করছে, যার মধ্যে রয়েছে এনভিডিয়া এবং এএমডি চিপ, যা উচ্চতর প্রযুক্তির অংশ এবং সামরিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মার্কিন ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত পণ্য হওয়া সত্ত্বেও এই রপ্তানি কার্যক্রম বৈধ বলে দাবী করা হয়েছে।
২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে প্রায় ১,১১১টি ডেল পাওয়ারএজ সার্ভার রাশিয়ায় রপ্তানি করা হয়, যার মূল্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ধরনের চিপ এবং সার্ভারগুলো সাধারণত সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং পশ্চিমা দেশগুলি এই উন্নত প্রযুক্তি রাশিয়ার কাছে পৌঁছানো রোধ করতে চায়। কিন্তু শ্রেয়ার এই সরবরাহ একটি বড় ফাঁক তৈরি করছে, যার ফলে রাশিয়া উচ্চ প্রযুক্তির সরবরাহ পাচ্ছে এবং এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের উদ্বেগ বাড়ছে।
আরও পড়ুনঃ এআই প্রতিযোগিতায় পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার প্রযুক্তি জায়ান্টদের
ভারত রাশিয়ার সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বৈধ সুযোগ রাখে কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অংশ নয়। এছাড়াও, ভারত ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জামগুলির ওপর নির্ভরশীল এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করে আসছে, বিশেষ করে যখন ইউরোপীয় দেশগুলো এই আমদানি বন্ধ করেছে। এর ফলে, ভারত রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠেছে এবং শ্রেয়া লাইফ সায়েন্সেস সেই মধ্যস্থতার বড় একটি অংশ হিসেবে কাজ করছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় আমদানি তথ্য দেখায় যে, ২০২৪ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ১,৪০০টি ডেল পাওয়ারএজ XE9680 সার্ভার ভারত আমদানি করে, যেগুলি পরবর্তীতে রাশিয়ায় রপ্তানি করা হয়। এই সরবরাহ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া একটি মূল উৎস হিসেবে কাজ করছে, যেখানে ভারত একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে এই ধরনের উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করে তা রাশিয়ায় পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি করছে এবং এতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে।
শ্রেয়া লাইফ সায়েন্সেসের প্রতিষ্ঠাতা সুজিত কুমার সিং, ১৯৯৫ সালে মস্কোতে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথমে ফার্মাসিউটিক্যাল সরবরাহকেই কোম্পানির মূল ব্যবসা হিসেবে রাখেন। তবে সাম্প্রতিককালে কোম্পানি উচ্চতর প্রযুক্তি সরবরাহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে এই কোম্পানি রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ প্রযুক্তির উৎস হয়ে উঠেছে। এই ধরনের প্রযুক্তি রপ্তানির মাধ্যমে তারা একটি বড় আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে, কারণ রাশিয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
শ্রেয়া লাইফ সায়েন্সেস রাশিয়ায় প্রযুক্তি সরবরাহ করতে গিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার প্রযুক্তি প্রবেশ বন্ধ করতে চাইলেও, ভারতীয় আইন অনুসারে এই রপ্তানিতে কোনো সমস্যা নেই। এটি একটি আইনি ফাঁক তৈরি করেছে যা রাশিয়াকে নিষিদ্ধ পণ্য পেতে সহায়তা করছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভারতের এই ধরনের ব্যবসায়িক ভূমিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মার্কিন এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং তারা ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, রাশিয়ার সামরিক খাতে সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। তবে ভারতের সরকার এসব বিষয়কে সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করছে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ বজায় রেখে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়।
এই সরবরাহ প্রক্রিয়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাশিয়ার প্রমস্ভ্যাজব্যাঙ্কের সাথে শ্রেয়ার আর্থিক অংশীদারিত্ব। এটি একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক যা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এই ব্যাংকের ঋণ সম্পর্কিত নীতিমালা এবং ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে শ্রেয়ার জন্য আর্থিক সহায়তার একটি পথ তৈরি হয়েছে। যদিও এই ব্যাংকটির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, শ্রেয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, কারণ এটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
শ্রেয়া লাইফ সায়েন্সেসের এই ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি রপ্তানি কার্যক্রম কোম্পানির জন্য একটি বড় ব্যবসায়িক সুযোগ হলেও, এটি একইসাথে তাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এবং পরিণতির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। কোম্পানিটি তার মুল ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য থেকে সরে গিয়ে উচ্চতর প্রযুক্তি সরবরাহের দিকে মনোযোগ দিয়েছে, যা তাদের জন্য নতুন ধরনের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া উন্নত প্রযুক্তির অ্যাক্সেস পাচ্ছে।
শ্রেয়ার এ ধরনের রপ্তানি কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে যে আলোচনা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি রপ্তানি নীতির উপর প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের ফাঁক বন্ধ করার জন্য এবং নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।