কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি একটি জটিল বিষয়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের জিনগত, আচরণগত এবং পরিবেশগত উপাদান একত্রে কাজ করে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি যেমন ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি বা আচরণগত সমস্যা কিশোরদের জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে, তাই এই সমস্যাগুলির মূলে গিয়ে সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই সমস্যা নির্ধারণের জন্য একটি নতুন এবং বিস্তৃত পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, যা “বিগ ট্রল” নামে পরিচিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে বিভিন্ন জিনগত, আচরণগত এবং পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
জিনগত গবেষণায় “বিগ ট্রল” পদ্ধতির ভূমিকা
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি নতুন গবেষণাপদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যার নাম “বিগ ট্রল”। এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হল, এটি একটি বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, আচরণ এবং পরিবেশের সাথে জিনগত মার্কারগুলোর সম্পর্ক নির্ধারণে সাহায্য করে। “বিগ ট্রল” পদ্ধতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন জিনগত কারণগুলি খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন।
গবেষক নিকোল কার্চার এই গবেষণাকে মাছ ধরার সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে বড় জাল ব্যবহার করে ছোট মাছও ধরা হয়। তার মতে, এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত নানা জিনগত সম্পর্কগুলো বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করছে। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের জীবনচর্চার বিভিন্ন দিক থেকে এমন বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করে, যেগুলি ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
আরও পড়ুনঃ কুরআন ও বিজ্ঞান : সৃষ্টির রহস্যের মিলন
জিনগত ঝুঁকি এবং আচরণগত সমস্যার সম্পর্ক
মানুষের জেনোম এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার একটি সাধারণ পদ্ধতি হল জেনোম-ওয়াইড অ্যাসোসিয়েশন স্টাডিজ (GWAS)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে জিনগত ঝুঁকি এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায়। অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সাধারণ জিনগত সম্পর্ক রয়েছে, যেমন ডিপ্রেশনের সাথে অ্যানজাইটি বা মানসিক চাপের সম্পর্ক। গবেষকরা এই পদ্ধতির মাধ্যমে কেবল নির্দিষ্ট সমস্যার জিনগত সম্পর্কই নয়, বরং নতুন কিছু সম্পর্কও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, যা ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নির্ণয়ে নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
গবেষণার পরবর্তী ধাপে PheWAS নামক একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা GWAS পদ্ধতির বিপরীত। GWAS পদ্ধতিতে গবেষণার শুরুতে একটি নির্দিষ্ট মানসিক সমস্যার জন্য জিনগত মার্কারগুলো চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু PheWAS পদ্ধতিতে মানসিক সমস্যার সাথে সম্পর্কিত জিনগত মার্কারগুলোকে বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন আচরণ, লক্ষণ, পরিবেশগত পরিস্থিতি এবং শারীরিক সমস্যার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
PheWAS পদ্ধতির মাধ্যমে প্রায় ১,৩০০ থেকে ১,৭০০টি বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে স্ক্রিন টাইম, মানসিক চাপ, এবং অন্যান্য আচরণগত বৈশিষ্ট্য। এই পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষকরা কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত নানা বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন, যা ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণায় আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
গবেষণায় দেখা গেছে যে কিশোরদের বিভিন্ন আচরণ এবং পরিবেশের সাথে জিনগত ঝুঁকির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্ক্রিন টাইম এবং মানসিক চাপের মতো আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। গবেষণায় ১১টি GWAS নিয়ে চারটি জিনগত ঝুঁকির ধরন তৈরি করা হয়েছে, যা হল নিউরোডেভেলপমেন্টাল, ইন্টারনালাইজিং, কমপালসিভ এবং সাইকোটিক। গবেষণার ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে:
- নিউরোডেভেলপমেন্টাল ঝুঁকি: নিউরোডেভেলপমেন্টাল ঝুঁকির সাথে স্ক্রিন টাইম, ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক সমস্যা সম্পর্কিত আচরণ রয়েছে। এই ধরনের জিনগত ঝুঁকি ADHD, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এবং মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের সাথে যুক্ত।
- ইন্টারনালাইজিং ঝুঁকি: ইন্টারনালাইজিং ঝুঁকির সাথে মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন এবং স্ক্রিন টাইমের ব্যবহার সম্পর্কিত আচরণ পাওয়া গেছে। এই ঝুঁকি মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অ্যানজাইটি এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের সাথে সম্পর্কিত।
- সাইকোটিক ঝুঁকি: সাইকোটিক ঝুঁকির সাথে স্কুলে নিম্ন সম্পৃক্ততা এবং এনার্জি ড্রিংকসের ব্যবহার সম্পর্কিত আচরণ পাওয়া গেছে। এই ঝুঁকি মূলত সিজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সাথে যুক্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু জিনগত ঝুঁকির প্রকাশ আচরণে ঘটে এবং এটি পরিবর্তনযোগ্য। যেমন, স্ক্রিন টাইমের ব্যবহারকে প্রাথমিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ করা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পরিবর্তনযোগ্য আচরণের গুরুত্ব
গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কিছু জিনগত ঝুঁকি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে পরিবর্তনযোগ্য আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, স্ক্রিন টাইমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন সম্পর্কগুলোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য স্ক্রিন টাইম, মানসিক চাপ এবং এনার্জি ড্রিংকস খাওয়ার মতো কিছু পরিবর্তনযোগ্য আচরণ চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নির্ণয়ের জন্য নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছেন। গবেষণা চলাকালীন PheWAS পদ্ধতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, যা ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।