বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইঞ্জিনিয়াররা ক্ষুদ্র আকৃতির ড্রোন তৈরি করার জন্য কাজ করছেন, যাতে উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করা যায়। সম্প্রতি বুম্বলবী আকৃতির ড্রোন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যেখানে ক্ষুদ্র সেন্সর ও ক্যামেরা রয়েছে। তবে কম্পিউটার চিপ এখনও ক্ষুদ্রকরণের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
সাধারণত ড্রোনের কম্পিউটার চিপ ক্যামেরা ও সেন্সর থেকে আসা ডেটা বিশ্লেষণ করে এবং সেই অনুযায়ী ড্রোনের গতি ও দিক নির্দেশ করে। এই চিপগুলো ১০ থেকে ৩০ ওয়াট পর্যন্ত শক্তি ব্যবহার করে, যা ক্ষুদ্র ড্রোনের ক্ষেত্রে ভারি ব্যাটারির প্রয়োজন পড়ে।
এ সমস্যার সমাধান করতে এমআইটির ইঞ্জিনিয়াররা একটি নতুন কম্পিউটার চিপ ডিজাইন করেছেন, যা অনেক কম শক্তি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ড্রোন পরিচালনার ক্ষমতা রাখে। তারা এ চিপটির নাম দিয়েছেন “নেভিয়ন” (Navion)। এটি এমআইটির রোবটিক্স: সায়েন্স অ্যান্ড সিস্টেম কনফারেন্সে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বে এই প্রথম নন-ইলেকট্রিক টাচপ্যাড তৈরি করেছে ফিনল্যান্ডের গবেষকরা
এমআইটির অ্যারোনটিক্স ও অ্যাস্ট্রোনটিক্স বিভাগের অধ্যাপক সারতাক কারামান এবং বৈদ্যুতিক প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ভিভিয়েন সজে একটি কম শক্তি ব্যবহারকারী অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন। এ অ্যালগরিদমটি কম শক্তি খরচ করে কাজ করার জন্য উপযোগী করে হার্ডওয়্যার তৈরি করতে সহায়ক। তাদের মূল অবদান হলো নতুনভাবে হার্ডওয়্যার ও অ্যালগরিদম একসাথে ডিজাইন করা। তারা দেখেছেন যে, অ্যালগরিদম এবং হার্ডওয়্যার একসাথে ডিজাইন করলে বেশি শক্তি সাশ্রয় করা সম্ভব হয়।
ড্রোনের মস্তিষ্কের প্রথম ধাপ
নতুন চিপটি প্রতি সেকেন্ডে ২০টি ফ্রেম বিশ্লেষণ করতে পারে এবং ড্রোনের অবস্থান নির্ধারণ করতে মাত্র ২ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে, যা বর্তমান চিপের তুলনায় অনেক কার্যকর। কারামান বলেন, তাদের ডিজাইনটি “স্বনির্ভর ক্ষুদ্রতম ড্রোন” তৈরির প্রথম ধাপ। তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে এটি দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও অনুসন্ধান এবং উদ্ধার মিশনে ব্যবহৃত হবে। ক্ষুদ্র ড্রোনগুলো দুর্ঘটনাস্থলে ক্ষুদ্র স্থানগুলিতে প্রবেশ করে খোঁজ নেওয়ার জন্য উপযুক্ত হবে।
ক্ষুদ্র ড্রোনের জন্য চিপ ডিজাইন
বর্তমানে ক্ষুদ্র ড্রোনের প্রোটোটাইপগুলো মানুষের আঙুলের টিপে বসতে পারে এবং এরা মাত্র ১ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে উড়তে পারে। তাদের সাথে থাকা ক্যামেরা ও সেন্সরও প্রায় অর্ধ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে। তবে সমস্যাটি ছিল কম্পিউটার চিপের। এত ছোট এবং শক্তি সাশ্রয়ী চিপ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না।
কারণ, প্রচলিত চিপ ডিজাইন পদ্ধতি দিয়ে এ ধরনের চিপ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না, যা যথেষ্ট ছোট এবং যথেষ্ট প্রসেসিং ক্ষমতা সম্পন্ন হতে পারে। ইঞ্জিনিয়াররা তাই একটি বিশেষায়িত চিপ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে ডেটা প্রসেসিংয়ের জন্য অ্যালগরিদম এবং হার্ডওয়্যার একসাথে ডিজাইন করা হয়েছে।
ফর্মুলার সামান্য পরিবর্তন
ইঞ্জিনিয়াররা একটি প্রচলিত অ্যালগরিদমের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এনেছেন, যা ড্রোনের নিজস্ব গতিবিধি বা অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে সহায়তা করে। তারপর তারা এ অ্যালগরিদমের বিভিন্ন সংস্করণ “ফিল্ড-প্রোগ্রামেবল গেট অ্যারে” (FPGA) নামে একটি প্রোগ্রামেবল চিপে প্রয়োগ করেন। এই প্রক্রিয়াটি আনুষ্ঠানিক করতে তারা “ইটারেটিভ স্প্লিটিং কো-ডিজাইন” পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যা শক্তি সাশ্রয়ের পাশাপাশি সঠিকতার ভারসাম্য বজায় রাখে।
একটি সাধারণ FPGA-তে লক্ষাধিক সংযুক্ত নয় এমন গেট থাকে, যা গবেষকরা প্রয়োজন অনুযায়ী সংযোগ করে বিশেষায়িত কম্পিউটিং উপাদান তৈরি করতে পারেন। কো-ডিজাইন পদ্ধতিতে গেটের সংখ্যা কমিয়ে এনে তারা একটি FPGA চিপ বেছে নেন, যার ফলে শক্তি সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ এবার আপনার স্বপ্ন রেকর্ড হবে : জাপানি বিজ্ঞানিদের নতুন আবিষ্কার
মেমোরি সাশ্রয়
চিপ ডিজাইন করতে গিয়ে গবেষকরা আরও দেখতে পেয়েছেন যে, তারা অ্যালগরিদমের প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ডেটার পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে একই ফলাফল পেতে পারেন। এর ফলে চিপটিতে কম ডেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে এবং শক্তি খরচও কমেছে।
ভিভিয়েন সজে বলেন, “মেমোরি শক্তির দিক থেকে অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমরা চিপে যেকোনো ডেটা আসার সাথে সাথে যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াকরণ করে সেটিকে দ্রুত ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করি, যাতে কম মেমোরি সংরক্ষণ করা যায়।”
এই পদ্ধতিতে তারা চিপের মেমোরি সংরক্ষণ ক্ষমতা কমিয়ে মাত্র ২ মেগাবাইটে নিয়ে এসেছেন, যেখানে সাধারণত ড্রোনের এমবেডেড কম্পিউটার চিপে মেমোরি থাকে কয়েক গিগাবাইটের। এর ফলে এটি আরও শক্তি সাশ্রয় করেছে।
এভাবে তারা চিপের শক্তি খরচ কমিয়ে চিপের আকারও কমিয়েছেন, যা ক্ষুদ্র ড্রোনে ব্যবহার উপযোগী। সামনের গ্রীষ্মে তারা চিপটিকে ড্রোনে মাউন্ট করে এর কার্যকারিতা পরীক্ষার পরিকল্পনা করছেন। তারা আশা করেন, চিপটি একটি অ্যাপ্লিকেশন-স্পেসিফিক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (ASIC) চিপে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এটি আরও বেশি শক্তি সাশ্রয়ী এবং কার্যকরী হবে।
ক্ষুদ্র ড্রোনের উন্নয়ন এ প্রযুক্তির জন্য বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি শুধু অনুসন্ধান এবং উদ্ধার মিশনেই নয়, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজেও সাহায্য করতে পারবে। যেমন একটি বোতলাকৃতির ড্রোন, যা মোবাইল ফোনের সাথে সংযুক্ত হয়ে ব্যবহারকারীর হাতের তালুতে রাখা যাবে এবং তার নির্দেশে আকাশে উড়ে গিয়ে ভিডিও রেকর্ড করবে।
এছাড়াও, ক্ষুদ্র ড্রোনগুলো সহজেই প্রয়োজনীয় স্থানে প্রবেশ করতে পারবে, যা বড় আকারের ড্রোনের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমে এটি বিশেষ সুবিধা দেবে। বিশেষ করে, দুর্ঘটনাস্থলে চাপা পড়ে থাকা লোকজনের খোঁজ করা বা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রবেশ করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার কাজে এটি অত্যন্ত কার্যকর হবে।
তাছাড়া, ড্রোনগুলোর ব্যবহারের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাহক ইলেকট্রনিকসের ক্ষেত্রে ছোট আকৃতির ড্রোন মানুষকে নতুন অভিজ্ঞতা দিতে পারে। এছাড়াও বাণিজ্যিক, সামরিক এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজেও এ ধরনের ড্রোনের ব্যবহার বাড়তে পারে।
চিপটি আরও উন্নত করার জন্য এবং শক্তি সাশ্রয় করার লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়াররা এ প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ধরনের অপ্টিমাইজেশন করতে পারবেন, যা ব্যাটারি সাইজ কমানো কিংবা ব্যাটারির আয়ু বাড়াতে সহায়ক হবে। এর ফলে ড্রোনের ওজন কমানো যাবে এবং এটি আরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে সক্ষম হবে।
এই গবেষণা আংশিকভাবে ইউএস এয়ার ফোর্স অফিস অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে। গবেষকদের মতে, এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আরও নানা ধরনের অপ্টিমাইজেশন করা সম্ভব, যা শক্তি সাশ্রয়ে অনেক বেশি সহায়ক হবে।