প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে প্রেরণা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এক নতুন ধরণের প্রযুক্তি যা ড্রোন ও রোবোটিক ডিভাইসের দৃষ্টিশক্তিকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে। দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকরা বিড়ালের চোখ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি উন্নত ভিশন সিস্টেম তৈরি করেছেন, যা স্বয়ংক্রিয় ড্রোন ও রোবটের কার্যকারিতা এবং কার্যকরভাবে বিভিন্ন পরিবেশে তাদের দক্ষতা বাড়াতে সক্ষম হবে। এই প্রযুক্তিটি অপ্রয়োজনীয় আলো ফিল্টার করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের লেন্স এবং সেন্সর ব্যবহার করে, যা বিড়ালের চোখের স্লিট-আকৃতির পিউপিলের মতো কাজ করে। এটি একদিকে যেমন বিভিন্ন আলোক পরিস্থিতিতে বস্তু সনাক্তকরণ এবং চিনতে সহায়তা করে, অন্যদিকে জ্বালানি সাশ্রয়ও করে।
প্রকৃতিতে বিড়ালের চোখের গঠন আমাদের সামনে এমন একটি ধারণা দেয়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলোর জন্য খুবই উপকারী হতে পারে। বিড়ালদের চোখের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের চোখের পিউপিলগুলো দিনে স্লিট-আকৃতির হয়, যা তাদের প্রখর আলো থেকে রক্ষা করে এবং সূক্ষ্মভাবে আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। রাতে এই পিউপিলগুলো অনেক বড় হয় এবং বেশি আলো গ্রহণ করে, যা অন্ধকারেও ভালো দেখার সক্ষমতা দেয়। এছাড়াও, বিড়ালের চোখে একটি প্রতিফলিত স্তর থাকে, যাকে বলা হয় ‘টাপেটাম লুসিডাম‘, যা রাতের বেলায় তাদের দৃষ্টিশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। গবেষকরা এই কাঠামো থেকে প্রেরণা নিয়ে রোবট এবং ড্রোনের জন্য একটি উন্নত ভিশন সিস্টেম তৈরি করেছেন।
গোয়াংজু ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (GIST) প্রফেসর ইয়ং মিন সং-এর নেতৃত্বে একদল কোরিয়ান গবেষক বিড়ালের চোখের গঠনের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন ধরনের ভিশন সিস্টেম তৈরি করেছেন। এই ভিশন সিস্টেমে একটি উন্নত লেন্স এবং সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিড়ালের চোখের স্লিট-আকৃতির পিউপিলের মতো কাজ করে। এটি অপ্রয়োজনীয় আলো ফিল্টার করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর উপর মনোযোগ দেয়। এছাড়াও, এই সিস্টেমে একটি প্রতিফলিত স্তর যুক্ত করা হয়েছে, যা বিড়ালের টাপেটাম লুসিডামের মতো কাজ করে এবং কম আলোতেও দৃশ্যমানতা উন্নত করে।
আরও পড়ুনঃ এবার আপনার স্বপ্ন রেকর্ড হবে : জাপানি বিজ্ঞানিদের নতুন আবিষ্কার
এই গবেষণা সম্প্রতি ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি কৃত্রিম ভিশন সিস্টেমের ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এর ফলে স্বয়ংক্রিয় রোবোটিক ডিভাইসগুলো আরো উন্নত বস্তু সনাক্তকরণ এবং চিনতে সক্ষম হবে, যা তাদের প্রযুক্তিগত কার্যকারিতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
প্রফেসর ইয়ং মিন সং-এর মতে, “রোবোটিক ক্যামেরাগুলো প্রায়শই ব্যস্ত বা কেমোফ্লেজড পটভূমিতে বস্তুর অবস্থান শনাক্ত করতে সমস্যায় পড়ে, বিশেষ করে যখন আলোর পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। আমাদের ডিজাইন এই সমস্যার সমাধান করে, যা রোবটগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বিবরণগুলোকে ব্লার করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর উপর মনোযোগ দিতে সহায়তা করে।” এই প্রযুক্তি একটি অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে, কারণ এটি ভারী কম্পিউটার প্রসেসিংয়ের উপর নির্ভর না করে, বরং লেন্সের ডিজাইন দ্বারা দৃষ্টিশক্তিকে উন্নত করে। এর ফলে এটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং কার্যকরী।
এই প্রযুক্তি বাস্তব জগতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। উন্নত এই ভিশন সিস্টেমটি ড্রোন, নিরাপত্তা রোবট, এবং স্বয়ংচালিত গাড়ির কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলবে, যা তাদের জটিল পরিবেশে সহজে চলাচল করতে এবং সুনির্দিষ্টভাবে কাজ সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে। সার্চ-অ্যান্ড-রেসকিউ অপারেশন থেকে শুরু করে শিল্প পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত এই প্রযুক্তি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মানুষের প্রচেষ্টার পরিপূরক অথবা তার বিকল্প হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা রাখে।
রোবটিক ভিশন সিস্টেমের ব্যবহার শুধুমাত্র রোবোটিক্সের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নিরাপত্তা রোবটগুলো বিভিন্ন বিপজ্জনক এলাকা পর্যবেক্ষণ করতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হতে পারে। এধরণের রোবটগুলো উন্নত ভিশন সিস্টেমের মাধ্যমে সহজেই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে, যা বর্তমান প্রযুক্তির তুলনায় অনেকটাই উন্নত।
স্বয়ংচালিত গাড়ির ক্ষেত্রে, এই ধরনের ভিশন সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং সিস্টেমকে আরো নিরাপদ এবং কার্যকরী করতে সহায়তা করবে। বর্তমানে স্বয়ংচালিত গাড়িগুলোর বড় একটি সমস্যা হলো বিভিন্ন আলোক পরিস্থিতিতে তাদের কার্যকারিতা বজায় রাখা। কিন্তু বিড়ালের চোখ থেকে প্রেরিত এই প্রযুক্তি সেই সমস্যার সমাধান করতে পারে, যা তাদের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতাকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে।
ড্রোনের ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে, অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে ড্রোনগুলোকে বিভিন্ন পরিবেশে চলাচল করতে হয়, যেখানে আলোর তারতম্য এবং পটভূমির জটিলতা তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এই উন্নত ভিশন সিস্টেম তাদেরকে সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে, যা তাদের কার্যকারিতা বাড়াবে এবং উদ্ধার প্রচেষ্টা সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আরও পড়ুনঃ ইঞ্জিনিয়ারদের চ্যালেঞ্জ ক্ষুদ্র আকৃতির ড্রোন তৈরিতে
এই গবেষণা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্সের ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বিড়ালের চোখের গঠন থেকে প্রেরণা নিয়ে তৈরি করা এই ভিশন সিস্টেম বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় ডিভাইসের কার্যকারিতা বাড়াতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে, এই ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলোকে আরো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এবং দক্ষ করে তোলা সম্ভব হবে, যা মানুষের জীবনে আরো উন্নতি বয়ে আনবে।
প্রকৃতির কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান খোঁজা একটি অসাধারণ উদ্যোগ। বিড়ালের চোখের গঠনের মাধ্যমে আমরা দেখেছি কিভাবে আলোর তারতম্য মোকাবিলা করা যায় এবং অপ্রয়োজনীয় আলো ফিল্টার করা যায়। এই প্রযুক্তি শুধু রোবোটিক্সের ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এই ধরনের ভিশন সিস্টেম আমাদের স্বয়ংক্রিয় ডিভাইসগুলোকে আরো উন্নত করতে এবং নতুন মাত্রায় কার্যকরী করতে সক্ষম হবে।
এই প্রযুক্তিটি প্রমাণ করেছে যে প্রাকৃতিক উপাদানগুলো থেকে আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারি। বিড়ালের চোখ থেকে প্রেরণা নিয়ে তৈরি করা এই ভিশন সিস্টেম আমাদের স্বয়ংক্রিয় ডিভাইসগুলোকে আরো উন্নত করতে এবং তাদের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন নিরাপত্তা, স্বয়ংচালিত গাড়ি, এবং ড্রোনে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে। ভবিষ্যতে, এই ধরনের প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে এবং মানুষের প্রচেষ্টা এবং কাজকে আরো সহজ করে তুলবে।