ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পার্থক্য

ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন পারমাণবিক কণিকা, যেগুলো কোনো পরমাণুর গঠন এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কণিকাগুলোর বৈশিষ্ট্য, চার্জ এবং ভরের মধ্যে পার্থক্যগুলো বুঝতে পারলে আমরা পরমাণুর গঠন এবং তার বিভিন্ন ক্রিয়াবলীর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। এই প্রবন্ধে আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পার্থক্য, তাদের চার্জ এবং ভর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রন কি ?

ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন হলো তিনটি প্রধান পারমাণবিক কণিকা, যেগুলো একটি পরমাণুর কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াস) ও তার চারপাশে থাকে। পরমাণুর গঠন এবং রাসায়নিক গুণাগুণ নির্ধারণে এই কণিকাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পরমাণু নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে প্রোটন এবং নিউট্রন থাকে এবং নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন ঘূর্ণায়মান থাকে।

  • ইলেকট্রন (Electron): ইলেকট্রন হলো একটি মৌলিক উপপরমাণুক কণা যা প্রোটন এবং নিউট্রনের পাশাপাশি পরমাণুর মূল গঠন সৃষ্টি করে। এটি একটি ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কণা, যার মানে এটি প্রোটনের বিপরীত চার্জ বহন করে। ইলেকট্রন খুবই ক্ষুদ্র এবং এর ভর অত্যন্ত কম; এটি প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের প্রায় ১/১৮৩৬ অংশ। এই কণাগুলি পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান থাকে, যেখানে ইলেকট্রনগুলির বিভিন্ন শক্তিস্তরে অবস্থান করতে পারে। ইলেকট্রনগুলির এই বিন্যাস পরমাণুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক ইলেকট্রনের একটি নির্দিষ্ট স্পিন থাকে, যা তাদের চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সহায়ক। ইলেকট্রন মুক্ত অবস্থাতেও থাকতে পারে, যা বিভিন্ন তড়িৎচৌম্বকীয় বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ পরিবহন ইলেকট্রনের গতি দ্বারা ঘটে এবং এটি বৈদ্যুতিক স্রোত সৃষ্টি করে। আধুনিক পদার্থবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলির মধ্যে ইলেকট্রনের গবেষণা অন্যতম, কারণ এটি কেবলমাত্র পদার্থের গঠন নয় বরং বিদ্যুৎ, চৌম্বকত্ব এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার মূল তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
  • প্রোটন (Proton): প্রোটন একটি মৌলিক উপপরমাণুক কণা যা পরমাণুর কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াসে) অবস্থান করে এবং একটি ধনাত্মক চার্জ বহন করে। প্রতিটি প্রোটনের চার্জ ইলেকট্রনের চার্জের সমান কিন্তু বিপরীত, অর্থাৎ ধনাত্মক (+১) চার্জযুক্ত। প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় ১৮৩৬ গুণ বেশি, যা পরমাণুর মোট ভরের অধিকাংশই নির্ধারণ করে। নিউক্লিয়াসে প্রোটনের পাশাপাশি নিউট্রনও থাকে, এবং এই দুটি কণা একসঙ্গে নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রোটনের সংখ্যা একটি পরমাণুর মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে, কারণ এটিই পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা। উদাহরণস্বরূপ, একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে মাত্র একটি প্রোটন থাকে, যেখানে কার্বনের নিউক্লিয়াসে ছয়টি প্রোটন থাকে। পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তিত হলে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মৌল হয়ে ওঠে। প্রোটন কণা পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও কসমোলজির ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানীরা প্রোটনের গঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং জানতে পেরেছেন যে এটি কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন দিয়ে তৈরি, যা শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। প্রোটন গবেষণা মহাবিশ্বের গঠন ও বিকাশ সম্পর্কে গভীরতর জ্ঞান লাভে সহায়ক হয়েছে।
  • নিউট্রন (Neutron): নিউট্রন একটি মৌলিক উপপরমাণুক কণা যা পরমাণুর কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াসে) প্রোটনের সঙ্গে অবস্থান করে এবং এতে কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই, অর্থাৎ এটি নিরপেক্ষ। নিউট্রনের ভর প্রোটনের প্রায় সমান, তবে এটি সামান্য বেশি। প্রোটন ও নিউট্রনের মিলিত ভর পরমাণুর মোট ভর গঠন করে, যা পরমাণুর স্থায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের উপস্থিতি পরমাণুকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, কারণ এটি প্রোটনের মধ্যে থাকা ধনাত্মক চার্জের বিকর্ষণকে সামঞ্জস্য করে। নিউট্রনের সংখ্যা বিভিন্ন আইসোটোপের গঠন নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। একই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের পরমাণুর কেন্দ্রে একই সংখ্যক প্রোটন থাকে, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেনের একটি আইসোটোপে কোনো নিউট্রন নেই, তবে ডিউটেরিয়াম এবং ট্রাইটিয়ামে যথাক্রমে এক ও দুইটি নিউট্রন থাকে। নিউট্রন গবেষণায় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন ও নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে, কারণ নিউট্রন চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তি উত্পাদন সম্ভব হয়। এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়, যা মহাবিশ্বের গঠন ও বিকাশ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনে সহায়ক হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ ন্যানো টেকনোলজি কি? এবং ন্যানো টেকনোলজি কিভাবে আমাদের উপকারে আসে?

অরবিট কী ?

পরমাণুর অরবি (orbital) হলো সেই অঞ্চল বা এলাকা যেখানে ইলেকট্রনের অবস্থানের সম্ভাবনা সর্বাধিক থাকে। অরবিগুলোকে সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন শক্তিস্তর বা শক্তিস্তরের উপস্তরে ভাগ করা হয়। পরমাণুর কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের চারপাশে বিভিন্ন অরবি স্তরে ইলেকট্রন ঘোরে, যা তাদের শক্তি এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। প্রাথমিকভাবে অরবিগুলোকে s, p, d এবং f ধরনের অরবিতে ভাগ করা হয়, যা ইলেকট্রনের গঠন এবং পরমাণুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি অরবিতে ইলেকট্রনের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, s অরবিতে সর্বোচ্চ ২টি ইলেকট্রন থাকতে পারে, p অরবিতে ৬টি, d অরবিতে ১০টি এবং f অরবিতে ১৪টি। ইলেকট্রন একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে, যা সাধারণত আলো বা শক্তি শোষণ বা নির্গমনের মাধ্যমে ঘটে। অরবিগুলোর এই শক্তিস্তর স্থানান্তর পরমাণুর বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং আলোর বিকিরণ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সহায়ক হয়।

ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পার্থক্য

ছবিঃ ফ্রিপিক/brgfx

ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পার্থক্য

ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের চার্জ, অবস্থান এবং ভরের উপর নির্ভর করে। নিচে এই পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হলো:

  • চার্জ: ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক (-1), প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক (+1), এবং নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই (নিরপেক্ষ)।
  • অবস্থান: ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান থাকে, প্রোটন এবং নিউট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থান করে।
  • ভর: প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর প্রায় সমান হলেও, ইলেকট্রনের ভর প্রোটন এবং নিউট্রনের তুলনায় প্রায় 1836 গুণ কম।

ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের চার্জ

প্রত্যেকটি পারমাণবিক কণিকার একটি নির্দিষ্ট চার্জ থাকে, যা পরমাণুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • ইলেকট্রনের চার্জ: ইলেকট্রনের চার্জ -1। এটি একটি ঋণাত্মক চার্জ বহন করে, যা পরমাণুর ধনাত্মক প্রোটনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমগ্র পরমাণুকে নিরপেক্ষ রাখে।
  • প্রোটনের চার্জ: প্রোটনের চার্জ +1। এটি একটি ধনাত্মক চার্জ বহন করে এবং পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে।
  • নিউট্রনের চার্জ: নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। এটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, যা নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রনের আধান কত?

প্রোটন এবং ইলেকট্রনের চার্জের পরিমাণ সমান হলেও তাদের দিক ভিন্ন।

  • প্রোটন: প্রোটনের আধান +1।
  • ইলেকট্রন: ইলেকট্রনের আধান -1।
  • নিউট্রন: নিউট্রনের আধান শূন্য, অর্থাৎ এটি কোনো আধান বহন করে না।

এই চার্জগুলোর পার্থক্য পরমাণুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। চার্জের এই বৈশিষ্ট্যই মূলত কণিকাগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্রিয়াকলাপ সৃষ্টি করে এবং পরমাণুর মধ্যকার আকর্ষণ-বিকর্ষণের জন্য দায়ী।

নিউট্রন ও প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের ভর থেকে কত গুণ বেশি?

নিউট্রন ও প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের তুলনায় অনেক বেশি। প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর প্রায় সমান, যা ইলেকট্রনের ভরের তুলনায় প্রায় 1836 গুণ বেশি।

  • প্রোটনের ভর: প্রোটনের ভর প্রায় 1.673 × 10⁻²⁷ কেজি।
  • নিউট্রনের ভর: নিউট্রনের ভর প্রায় 1.675 × 10⁻²⁷ কেজি।
  • ইলেকট্রনের ভর: ইলেকট্রনের ভর প্রায় 9.109 × 10⁻³± কেজি।

এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর ইলেকট্রনের ভরের তুলনায় প্রায় 1836 গুণ বেশি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এই ভরের পার্থক্যই পরমাণুর ভর এবং ঘনত্ব নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুনঃ পারমাণবিক শক্তি: কি, কেন ও কিভাবে?

পারমাণবিক গঠনে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের ভূমিকা

ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন পরমাণুর গঠন এবং তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রোটন এবং নিউট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে এবং পরমাণুর মূল ভর গঠন করে। অন্যদিকে, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান থাকে এবং পরমাণুর রাসায়নিক গুণাগুণ নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে।

  • প্রোটনের ভূমিকা: প্রোটন কোনো পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা নির্ধারণ করে, যা সেই পরমাণুর মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সহায়ক। প্রোটনের সংখ্যা বাড়ানো বা কমানোর মাধ্যমে নতুন মৌল তৈরি হয়।
  • নিউট্রনের ভূমিকা: নিউট্রন প্রোটনের সাথে বন্ধন গঠন করে নিউক্লিয়াসকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। নিউট্রনের সংখ্যা পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন আইসোটোপ তৈরি হয়, যা একক মৌল কিন্তু ভিন্ন ভর সংখ্যা ধারণ করে।
  • ইলেকট্রনের ভূমিকা: ইলেকট্রন রাসায়নিক বন্ধন গঠন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ইলেকট্রনের সংখ্যা পরিবর্তনের মাধ্যমে পরমাণু আয়ন হিসেবে পরিণত হয়, যা বিদ্যুৎ পরিবাহিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন হলো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কণিকা, যেগুলো পরমাণুর গঠন এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করে। প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর ইলেকট্রনের তুলনায় অনেক বেশি এবং এদের চার্জের ধরনও আলাদা। এই কণিকাগুলোর মধ্যে পার্থক্যগুলো বুঝলে পরমাণুর গঠন এবং তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব। আশা করছি, এই প্রবন্ধটি আপনাকে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে সহায়ক হবে।

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো