বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা হলো নিরাপদ পানির অভাব। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, যার মধ্যে একটি নতুন পানির সংগ্রহকারী পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। এটি প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় অর্ধেক শক্তি ব্যবহার করে বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই প্রবন্ধে আমরা নতুন ধরনের এই পানির সংগ্রহকারী যন্ত্রের কার্যকারিতা এবং তার সুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
এই নতুন প্রোটোটাইপ পানির সংগ্রহকারী যন্ত্রটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি তাপমাত্রা-সংবেদনশীল উপাদান ব্যবহার করে কাজ করে। এই যন্ত্রটি নিকেল-টাইটেনিয়াম ভিত্তিক ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার করে, যা মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রচলিত যন্ত্রগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পানি সংগ্রহ করতে পারে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় প্রায় অর্ধেক শক্তি ব্যবহার করে। এই প্রোটোটাইপটি সহজে বহনযোগ্য এবং ব্যাকপ্যাকে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যা প্রচলিত বড় ও জটিল যন্ত্রগুলোর তুলনায় অনেক সুবিধাজনক।
অনেক প্রচলিত পানি সংগ্রহকারী যন্ত্র বড়, শক্তি-সাশ্রয়ী নয় এবং ধীর গতিতে কাজ করে। নতুন এই প্রোটোটাইপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এলাস্টোক্যালোরিক কুলিং প্রযুক্তি, যা শক্তি ব্যবহার, আকার এবং জটিলতা কমাতে সাহায্য করে। এলাস্টোক্যালোরিক কুলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে উপাদানগুলির মাধ্যমে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় শক্তি ব্যবহার কমানো হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করায় প্রোটোটাইপটি অনেক সহজ ও ছোট হয়েছে, যা একে পোর্টেবল করেছে।
আরও পড়ুনঃ পানির জটিল হাইড্রোজেন বন্ড এর রহস্য উন্মেচন
এই গবেষণায় তৈরি যন্ত্রটির কার্যকারিতা প্রচলিত ডিহিউমিডিফায়ার যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রচলিত যন্ত্রগুলোতে ডেসিক্যান্ট চাকা ব্যবহার করা হয়, যা হাইড্রোফিলিক পদার্থ দিয়ে আবৃত থাকে এবং বাতাসের আর্দ্রতা সংগ্রহ করে। গবেষকরা ৩০ মিনিটের বিভিন্ন সেশনে তাদের যন্ত্র ও প্রচলিত যন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছেন। এতে দেখা গেছে, তাদের প্রোটোটাইপের শক্তি খরচ কম, তাপ উৎপাদন কম এবং পানি সংগ্রহের দক্ষতা বেশি।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, নতুন প্রোটোটাইপটি আর্দ্র পরিবেশে সর্বাধিক কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, হাইতি এবং ওহাইওর মতো জায়গায় এই যন্ত্রটি সর্বাধিক কার্যকর হবে, যেখানে আর্দ্রতা পর্যাপ্ত রয়েছে। প্রোটোটাইপটির কাঠামো মডুলার হওয়ায় এটি বিভিন্ন পরিবেশের প্রয়োজন অনুসারে স্কেল করা সম্ভব, যা এটিকে আরও মানানসই করে তোলে।
এই প্রোটোটাইপের মাধ্যমে উৎপাদিত পানি সরাসরি পান করা সম্ভব হলেও, যন্ত্রটি ৩ডি প্রিন্টেড উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ায় তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষয় হতে পারে এবং এতে মাইক্রোপ্লাস্টিক মেশার সম্ভাবনা থাকে। তাই পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তা ফিল্টার করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের দেয়া তথ্যমতে, পৃথিবীর মাত্র ০.৫% পানি মানব ব্যবহারের জন্য নিরাপদ ও তাজা পানি হিসেবে পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ এবং দূষণ পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার ফলে এই নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা দিন দিন কমছে। এর ফলে নিরাপদ পানির সংকট আরও গভীর হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থাগুলো এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। তাই সৃজনশীল উপায়ে পানি সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য।
এই প্রোটোটাইপের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো বাতাস থেকে পানি সংগ্রহের যন্ত্রগুলোকে আরও অর্থনৈতিক এবং বাস্তবসম্মত করা। যন্ত্রটি সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এবং কম শক্তি ব্যবহার করায় এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযোগী হতে পারে। ভবিষ্যতে এই প্রোটোটাইপটিকে বড় আকারে তৈরি করা সম্ভব, যা একটি বড় পরিবার বা সম্প্রদায়ের পানির প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে।
গবেষণার প্রধান লেখক জন লারকো বলেন, “বিশ্বের বাকি অংশের জন্য নিরাপদ পানি যেন শুধু একটি স্বপ্ন না থাকে। আমরা এই নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে চাই।” গবেষকদের মডেলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য নিজের ডিহিউমিডিফায়ার তৈরি করাও সম্ভব, যদিও বর্তমানে এটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় আকারে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে, যা একটি বাড়ি বা সম্প্রদায়ের চাহিদা পূরণ করবে।
গবেষক কুদসিয়া তাহমিনা উল্লেখ করেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থাগুলো পানির সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। তাই আমাদের এমন একটি যন্ত্র প্রয়োজন যা বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে এবং এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় ব্যবহৃত হতে পারে।
এই যন্ত্রটি তৈরি করতে এবং গবেষণা করতে প্রচুর সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে যে সুবিধা পাওয়া যাবে তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় আশীর্বাদ হতে পারে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেখানে নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে, সেখানে এই প্রযুক্তি অনেক বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
বর্তমান বিশ্বের পানির সংকট সমাধানে এই প্রযুক্তির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এটি বড় পরিসরে তৈরি করা হয় এবং সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি পানি সংকট মোকাবেলায় একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি শুধু পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করবে না, বরং এর মাধ্যমে অনেক সামাজিক সমস্যা যেমন স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানেও সাহায্য করবে।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে, সেখানে এই প্রযুক্তি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। গবেষকরা এই যন্ত্রটির উন্নয়নের জন্য আরও কাজ করছেন, যাতে এটি আরও কার্যকরী ও সাশ্রয়ী হয়। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে পানির সংকট সমাধানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে এবং এটি আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে।