জীবন্ত টিস্যু এবং প্রযুক্তি একত্রিত করা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। বায়োইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে এমন একটি সমাধান প্রয়োজন ছিল যা টিস্যুর মত নমনীয় এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মত কার্যক্ষম। সম্প্রতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এমন একটি সেমিকন্ডাক্টর হাইড্রোজেল (বায়োইলেক্ট্রনিক জেল) উদ্ভাবন করেছেন যা এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটি এমন একটি সেমিকন্ডাক্টর যা হাইড্রোজেলের মত জলীয় এবং টিস্যুর মত নমনীয়, ফলে এটি জীবন্ত টিস্যুর সাথে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত হতে পারে।
নতুন ধরনের সেমিকন্ডাক্টর হাইড্রোজেল
সাধারণত বায়োইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন পেসমেকার, বায়োসেন্সর এবং ড্রাগ ডেলিভারি ডিভাইস তৈরির জন্য সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব সেমিকন্ডাক্টরগুলো কঠিন, ভঙ্গুর এবং পানি-বিরোধী, যা টিস্যুর সাথে মেলানো কঠিন করে তোলে। এ কারণে জীবন্ত টিস্যুর সাথে সংযুক্ত করার সময় এই ধরনের ডিভাইসগুলো প্রায়ই শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন প্রদাহ তৈরি করে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিটজকার স্কুল অফ মলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সহকারী অধ্যাপক সিহং ওয়াং-এর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল একটি নতুন হাইড্রোজেল তৈরি করেছে যা সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটি দেখতে জেলিফিশের মতো জলীয় এবং নরম, অথচ এটি সেমিকন্ডাক্টরের মতই কার্যক্ষম। ফলে এটি জীবন্ত টিস্যুর সাথে সংযুক্ত হতে পারে এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কার্যকারিতা বজায় রাখতে পারে।
আরও পড়ুনঃ থ্রিডি স্মার্ট এনার্জি ডিভাইস তৈরি করেছে কোরিয়ার একদল ইঞ্জিনিয়ার
নতুন হাইড্রোজেলের গুণাবলী ও প্রয়োগ
এই নতুন হাইড্রোজেলটি টিস্যু স্তরের নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে, যার মডুলি ছিল প্রায় ৮১ কিলোপ্যাস্কাল এবং ১৫০% পর্যন্ত প্রসারণ ক্ষমতা রয়েছে। এর চার্জ-বহন ক্ষমতা ছিল ১.৪ সেমি² ভি-১ সেকেন্ড-১ পর্যন্ত। এর অর্থ হলো, এটি একসাথে সেমিকন্ডাক্টর এবং হাইড্রোজেল হিসাবে কার্যকরী হতে পারে, যা বায়োইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে আদর্শ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রথম লেখক ইয়াহাও দাই বলেন, “যখন আপনি কোনো ইমপ্লান্টেবল বায়োইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি করবেন, তখন আপনাকে এমন একটি ডিভাইস তৈরি করতে হবে যার যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য টিস্যুর মত। এভাবে, যখন এটি টিস্যুর সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে, তখন তারা একসাথে বিকৃত হতে পারবে এবং খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংযোগ তৈরি করতে পারবে।” এই হাইড্রোজেলটি টিস্যুর মত জলীয় এবং নরম হওয়ার কারণে এটি টিস্যুর সাথে স্বাভাবিকভাবেই একত্রিত হতে পারে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
এই নতুন উপাদানটি শুধুমাত্র ইমপ্লান্টেবল ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য নয়, বরং বিভিন্ন অ-সার্জিকাল প্রয়োগেও ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন ত্বকের উপর বায়োসেন্সিং বা ক্ষত নিরাময়ের উন্নত যত্ন। এটি টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ড্রাগ ডেলিভারির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী উপাদান হতে পারে।
হাইড্রোজেল তৈরির উদ্ভাবনী পদ্ধতি
সাধারণত হাইড্রোজেল তৈরির জন্য একটি পদার্থকে পানিতে গলানো হয় এবং তারপর জেলেশন রাসায়নিক যোগ করে সেটিকে একটি জেলের আকারে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর সাধারণত পানিতে গলে না। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।
তারা প্রথমে সেমিকন্ডাক্টরকে একটি জৈব দ্রাবক-এ গলিয়েছে, যা পানির সাথে মিশ্রণযোগ্য। তারপর তারা সেই দ্রবণ থেকে একটি অর্গানোজেল তৈরি করেছে, যা পানিতে নিমজ্জিত করে দ্রাবকটিকে বের করে দিয়ে জলের মধ্যে প্রবেশ করতে দিয়েছে। এভাবে তারা একটি কার্যক্ষম হাইড্রোজেল তৈরি করেছে, যা সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের পলিমার সেমিকন্ডাক্টরের সাথে কাজ করা সম্ভব, যা বিভিন্ন কার্যকারিতার জন্য উপযুক্ত হতে পারে। ফলে এটি বায়োইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে একটি বহুমুখী সমাধান প্রদান করেছে।
সেমিকন্ডাক্টর এবং হাইড্রোজেলের গুণাবলীর সম্মিলন
এই হাইড্রোজেল সেমিকন্ডাক্টরটি শুধু হাইড্রোজেলের সাথে সেমিকন্ডাক্টর মিশ্রিত করা নয়, বরং এটি একসাথে একটি উপাদান যা সেমিকন্ডাক্টর এবং হাইড্রোজেল উভয়ের গুণাবলী বহন করে। এটি একটি হাইড্রোজেলের মতোই নরম এবং জলীয়, অথচ সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্যও বজায় রেখেছে।
এই নতুন উপাদানটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জৈবিক কার্যকারিতা বাড়িয়েছে। প্রথমত, খুব নরম উপাদান হিসেবে এটি টিস্যুর সাথে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারে, যা ইমপ্লান্ট করা হলে প্রদাহ এবং ইমিউন প্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, হাইড্রোজেলের উচ্চ পরিসমতার কারণে এটি বায়োসেন্সিং প্রতিক্রিয়া এবং আলো-নিয়ন্ত্রণিত প্রভাব বাড়ায়। বায়োমলিকিউলগুলো সহজেই এই জেলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং ভলিউমেট্রিক ইন্টারঅ্যাকশন তৈরি করতে পারে, যা বায়োমার্কার শনাক্তকরণে সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও আলো-নিয়ন্ত্রিত থেরাপিউটিক ফাংশন যেমন পেসমেকার বা ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রে এই উপাদানটি আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আরও পড়ুনঃ আলোর মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান এর নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন
এই উদ্ভাবনী হাইড্রোজেল সেমিকন্ডাক্টরটি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলস্কি সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড ইনোভেশন-এর মাধ্যমে বাণিজ্যিকীকরণের পথে রয়েছে। এটি জীবন্ত টিস্যুর সাথে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবী সমাধান হতে পারে, যা চিকিৎসা ডিভাইসের কার্যকারিতা এবং সংযুক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে।
এই ধরনের উদ্ভাবনী সমাধান বায়োইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উন্নত এবং কার্যকর করতে সহায়তা করবে। এটি শুধু জীবন্ত টিস্যুর সাথে ইলেকট্রনিক্সের সেতুবন্ধন নয়, বরং ভবিষ্যতের চিকিৎসা ডিভাইস এবং থেরাপিউটিক উপকরণের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে।