বিশ্বজুড়ে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড়ো ধরণের পরিবর্তন ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যান্সার রোগ থেকে মুক্তির উপায় এর গবেষণা সরা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরে করে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি একটি নতুন গবেষণা প্রমাণ করেছে যে কিছু আক্রমণাত্মক ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব হতে পারে ক্যান্সারের বৃদ্ধির জন্য দায়ী ডিএনএ বা ‘এক্সট্রাক্রোমোজোমাল ডিএনএ’ (ecDNA) লক্ষ্য করে তাদের ধ্বংস করার মাধ্যমে। এই গবেষণার ফলাফল প্রমাণ করে যে ক্যান্সার কোষগুলির মধ্যে থাকা এই ডিএনএ বৃত্তগুলো ক্যান্সারকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
এই গবেষণাটি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশ কিছু জটিল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ডিএনএ এর কিছু অংশ ক্রোমোজোম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বৃত্ত আকারে তৈরি হয়, যা টিউমারকে টিকে থাকতে এবং চিকিৎসা প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রায় ১৫,০০০ ব্রিটিশ রোগীর ৩৯ প্রকারের টিউমার পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা দেখেছেন, ছয়টির মধ্যে একটিরও বেশি ক্যান্সারেই এই ধরণের ডিএনএ বৃত্ত থাকে, যা টিউমারকে নিরাময়ে অসুবিধা তৈরি করে।
আরও পড়ুনঃ কুরআন ও বিজ্ঞান : সৃষ্টির রহস্যের মিলন
ecDNA: ক্যান্সারের একটি গোপন উপাদান
ক্যান্সার কোষগুলির ecDNA ক্যান্সার বৃদ্ধির মূল চালক হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ecDNA বৃত্তগুলিতে থাকা কিছু জিন ক্যান্সারের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং কিছু জিন প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এই ধরনের ডিএনএ কোষের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক থাকে, এবং ক্যান্সারের কোষগুলো যখন বিভাজিত হয়, তখন ecDNA এর সংখ্যা অসমভাবে নতুন কোষগুলির মধ্যে চলে যায়। ফলে একটি কোষ অন্যটির চেয়ে বেশি ecDNA পেয়ে ক্যান্সারের শক্তি বৃদ্ধি করে দেয়।
গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ডিএনএ বৃত্তগুলি এমন কিছু জিন বহন করে যা ক্যান্সার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং একই সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। সাধারণত মানব কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে, যা কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে। কিন্তু কখনও কখনও ক্রোমোজোম থেকে কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে বৃত্ত আকারে ecDNA তৈরি করে, যা কোষের ক্রোমোজোমের বাইরে থাকে। পূর্বে ecDNA কে ক্যান্সারের জন্য অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হলেও, সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি ক্যান্সারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি
গবেষকরা ecDNA-কে লক্ষ্য করে একটি নতুন ওষুধের সন্ধান পেয়েছেন যা প্রাথমিক স্তরের ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে। এই ওষুধটি, যা CHK1 ইনহিবিটর নামে পরিচিত, ecDNA যুক্ত টিউমার কোষগুলোকে বেছে বেছে ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি ক্যান্সারের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় এবং ঐ কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। গবেষণার সময় একদল ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় দেখা গেছে যে CHK1 ইনহিবিটর প্রথাগত অ্যান্টি-ক্যান্সার ওষুধের সাথে একত্রে ব্যবহার করলে টিউমারকে কমাতে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা হ্রাস করতে সাহায্য করে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্যাথলজির অধ্যাপক পল মিশেল বলেন, “এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, কারণ এটি অনেক মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। এই গবেষণা আমাদের ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ে একটি নতুন পথ দেখিয়েছে, যেখানে অসাধারণ ডিএনএ বা ecDNA ক্যান্সারের দুর্বলতা হিসেবে কাজ করে।”
নতুন ধারণা: ecDNA এর উত্তরাধিকার এবং বিভাজন
গবেষকরা ecDNA-এর উত্তরাধিকার এবং কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা তুলে ধরেছেন। সাধারণত, কোষ বিভাজনের সময় ecDNA র্যান্ডম ভাবে নতুন কোষগুলির মধ্যে চলে যায়, ফলে এক একটি কোষে বিভিন্ন পরিমাণে ecDNA থাকে। এটি টিউমারের বিভিন্ন কোষকে বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেয়, যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, কোষ বিভাজনের সময় ecDNA-এর প্রতিলিপি তৈরি করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, যার ফলে ecDNA গুলো একত্রে থেকে নতুন কোষে চলে যায়। এটি ক্যান্সারের কোষগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং চিকিৎসার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নতুন অস্ত্র
ecDNA যুক্ত টিউমার কোষগুলির উপর গবেষণা থেকে গবেষকরা জানতে পেরেছেন যে, CHK1 প্রোটিনের কার্যকলাপ বন্ধ করে দিলে টিউমার কোষগুলি মারা যায় এবং টিউমারের বৃদ্ধি কমে যায়। এটি ক্যান্সার কোষগুলিকে একটি নতুন দুর্বলতা তৈরি করে দেয়।
গবেষকরা বলেন, “এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা শিখেছি যে ক্যান্সার কোষগুলি অতিরিক্ত প্রতিলিপির উপর নির্ভরশীল, এবং আমরা এটি একটি দুর্বলতা হিসেবে ব্যবহার করেছি যা তাদের ধ্বংস করে দেয়।”
ভবিষ্যতের চিকিৎসা
গবেষণার ফলাফল যথেষ্ট আশাজনক ছিল যে CHK1 ইনহিবিটর এখন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। গবেষকরা আশা করছেন যে এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ক্যান্সার রোগীদের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠবে, বিশেষ করে যাদের ক্যান্সার বর্তমান চিকিৎসায় সাড়া দেয় না।
গবেষণা এবং সহযোগিতা
এই গবেষণাগুলো বিভিন্ন গবেষণা দলের একত্রিত প্রচেষ্টার ফল। গবেষকরা বলেন, “বিজ্ঞান একটি সামাজিক উদ্যোগ এবং আমরা একত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে দেখিয়েছি যে এই আবিষ্কারগুলি বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ecDNA এর জীববিদ্যার উপর আরও গবেষণা চালিয়ে যাব এবং এই জ্ঞান ব্যবহার করে রোগীদের এবং তাদের পরিবারের জন্য উপকার বয়ে আনবো।”
গবেষণার এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে ক্যান্সার কোষের মধ্যে থাকা ecDNA ক্যান্সার বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এর বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব। গবেষণার এই ফলাফলগুলো আমাদেরকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি নতুন পথ দেখিয়েছে, যা রোগীদের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠতে পারে।