ডিএনএ কি
ডিএনএ (DNA) হলো আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর মধ্যে একটি। এটি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতরে থাকে এবং আমাদের সব তথ্য রাখে। ডিএনএ এর পূর্ণরূপ হলো “ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড” (Deoxyribonucleic Acid)। এটি আমাদের জন্ম, বৃদ্ধি, এবং শরীরের বিভিন্ন কাজ কিভাবে হবে তা ঠিক করে দেয়।
ডিএনএ দেখতে অনেকটা পেঁচানো সিঁড়ির মতো, যেটাকে বিজ্ঞানীরা ‘ডাবল হেলিক্স’ (double helix) বলে। এটি প্রোটিন এবং রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। ডিএনএতে কিছু বিশেষ কোড বা সংকেত থাকে, যেগুলো আমাদের শরীরের গঠন এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। এসব কোডের মাধ্যমে আমাদের চোখের রঙ, চুলের ধরন, এবং আমাদের দেহের গঠন কেমন হবে, সেটি নির্ধারণ হয়। এই কোডগুলোকে বলা হয় “জিন” (gene)। ডিএনএ আমাদের মায়ের এবং বাবার কাছ থেকে আসে, তাই আমাদের কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের মতই হয়।
ডিএনএ মূলত আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে থাকে এবং এই কোষগুলো আমাদের শরীরের সব ধরনের কাজ করে। ডিএনএ কোষকে নির্দেশনা দেয় কীভাবে কাজ করতে হবে, নতুন কোষ তৈরি করতে হবে, এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ঠিকভাবে চলতে হবে। যখন আমাদের দেহের কোষ বিভক্ত হয়, তখন ডিএনএও তার কপি তৈরি করে এবং নতুন কোষে চলে যায়।
ডিএনএ এমন একটি জিনিস, যা আমাদের শুধু মানুষ নয়, সব ধরনের প্রাণী, উদ্ভিদ এবং এমনকি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও থাকে। ডিএনএ আমাদের শরীরের নীলনকশার মতো কাজ করে। এটি না থাকলে, আমরা কিভাবে দেখতে লাগবো বা কিভাবে চলাফেরা করবো, সেইসব কোনো কিছুই ঠিক থাকতো না।
আরও পড়ুনঃ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পিতৃপরিচয় কিভাবে নিশ্চিত করা যায়?
ডিএনএ এর গঠন ব্যাখ্যা
ডিএনএ দেখতে অনেকটা পেঁচানো সিঁড়ির মতো। এই গঠনতন্ত্রকে ডাবল হেলিক্স (Double Helix) বলা হয়। ডিএনএ মূলত চার ধরনের নিউক্লিওটাইড দিয়ে গঠিত, যেগুলো হলো ১। অ্যাডেনিন (Adenine – A), ২। গুয়ানিন (Guanine – G), ৩। থাইমিন (Thymine – T), এবং ৪। সাইটোসিন (Cytosine – C)। এই চার নিউক্লিওটাইড পরস্পরের সাথে নির্দিষ্ট উপায়ে যুক্ত হয় এবং ডিএনএ-র গঠন তৈরি করে। অ্যাডেনিন সব সময় থাইমিনের সাথে এবং গুয়ানিন সব সময় সাইটোসিনের সাথে যুক্ত হয়। এই মিলনের মাধ্যমে ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স গঠন তৈরি হয়।
১। অ্যাডেনিন (Adenine – A):
- গঠন: অ্যাডেনিন হলো একটি পিউরিন বেস, যা ডাবল রিংযুক্ত। এটি একটি হেটারোসাইক্লিক যৌগ এবং রাসায়নিক সূত্র হলো C₅H₅N₅।
- ডিএনএ-তে সংযুক্তি: অ্যাডেনিন থাইমিনের (T) সঙ্গে দুটি হাইড্রোজেন বন্ড তৈরি করে, যা ডিএনএ-এর ডাবল-হেলিক্সের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে।
- আরএনএ-তে সংযুক্তি: আরএনএ-তে অ্যাডেনিন ইউরাসিলের (U) সাথে সংযুক্ত হয়।
- ফাংশন: অ্যাডেনিন জৈব রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি এনার্জি ক্যারিয়ার হিসেবে এডিনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২। গুয়ানিন (Guanine – G):
- গঠন: গুয়ানিনও একটি পিউরিন বেস, এবং এরও ডাবল রিং রয়েছে। এর রাসায়নিক সূত্র হলো C₅H₅N₅O।
- ডিএনএ-তে সংযুক্তি: গুয়ানিন সাইটোসিনের (C) সঙ্গে তিনটি হাইড্রোজেন বন্ড গঠন করে, যা ডিএনএ-এর স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
- ফাংশন: গুয়ানিন কোষে গঠনগত এবং কার্যকরী ভুমিকা রাখে। এটি জেনেটিক কোডকে সঠিকভাবে সজ্জিত করতে সাহায্য করে এবং জিনের তথ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ।
৩। থাইমিন (Thymine – T):
- গঠন: থাইমিন হলো একটি পিরিমিডিন বেস, যা একটি সিঙ্গেল রিংযুক্ত। এর রাসায়নিক সূত্র হলো C₅H₆N₂O₂।
- ডিএনএ-তে সংযুক্তি: থাইমিন অ্যাডেনিনের (A) সাথে দুটি হাইড্রোজেন বন্ড তৈরি করে। এটি ডিএনএ-এর ডাবল-হেলিক্সের স্ট্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সংযুক্তি গড়ে তোলে।
- ফাংশন: থাইমিন মূলত ডিএনএ-তে পাওয়া যায় এবং এর তথ্য সংরক্ষণ এবং পুনরুত্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪। সাইটোসিন (Cytosine – C):
- গঠন: সাইটোসিন একটি পিরিমিডিন বেস, যার একটি সিঙ্গেল রিং থাকে। এর রাসায়নিক সূত্র হলো C₄H₅N₃O।
- ডিএনএ-তে সংযুক্তি: সাইটোসিন গুয়ানিনের (G) সঙ্গে তিনটি হাইড্রোজেন বন্ড গঠন করে, যা ডিএনএ-এর ডাবল-হেলিক্সের শক্তি বাড়ায়।
- ফাংশন: সাইটোসিন কোষের জিনগত তথ্য সঠিকভাবে পরিবহণ ও সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রোটিন উৎপাদন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কোষীয় প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে।
ডিএনএ-এর গঠনে চারটি বেসের ভূমিকা
এই চারটি বেস জেনেটিক কোড বা ডিএনএ-এর বেস পেয়ারিংয়ের মাধ্যমে কোডন তৈরি করে, যা প্রোটিন সংশ্লেষণ এবং জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে। ডিএনএ-তে অ্যাডেনিন-থাইমিন এবং গুয়ানিন-সাইটোসিন বেস পেয়ার তৈরি করে, যা ডিএনএ-এর স্ট্র্যান্ডকে ডাবল হেলিক্স আকারে গঠন করে।
ডিএনএ-র মধ্যে ফসফেট ও শর্করা মলিকিউল দিয়ে গঠিত একটি মেরুদণ্ড আছে, যেটা ডিএনএ-র পেঁচানো গঠন ধরে রাখতে সহায়তা করে। নিউক্লিওটাইডগুলোর ক্রম বিন্যাস বা সিকোয়েন্স নির্ধারণ করে দেয় আমাদের শরীরের সমস্ত বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের দেহের বিভিন্ন কাজ কিভাবে হবে।
ডিএনএ এর কাজ কি
ডিএনএ-র প্রধান কাজ হলো আমাদের দেহের সমস্ত জিনগত তথ্য সংরক্ষণ এবং তা সঠিক সময়ে ব্যবহার করা। ডিএনএ-র কোডে থাকে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি করার নির্দেশনা, যা দেহের বিভিন্ন অংশ তৈরি করতে সহায়তা করে।
প্রোটিন হলো আমাদের দেহের ভিত্তি। ডিএনএ-র কোড অনুযায়ী রাইবোজোম নামক কোষের অঙ্গাণু প্রোটিন তৈরি করে। এই প্রোটিনগুলো দেহের বিভিন্ন কোষের কাজ পরিচালনা করে, যেমন কোষের বিভাজন, ক্ষতি মেরামত, এবং নতুন কোষ তৈরি করা। এছাড়াও, ডিএনএ-র কাজ হলো জিনগত তথ্য উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর করা। ডিএনএ থেকে তৈরি হয় আরএনএ (RNA), এবং এই আরএনএ প্রোটিন তৈরির নির্দেশ বহন করে।
ডিএনএ কোথায় থাকে
ডিএনএ আমাদের দেহের প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে (Nucleus) থাকে। নিউক্লিয়াস হলো কোষের কেন্দ্রীয় অংশ যেখানে সমস্ত জিনগত তথ্য সংরক্ষিত থাকে। কোষের নিউক্লিয়াস ছাড়াও ডিএনএ কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াতেও (Mitochondria) পাওয়া যায়, যেটা আমাদের কোষের শক্তি উৎপাদনের কাজ করে।
আমাদের দেহের প্রায় সমস্ত কোষে ডিএনএ থাকে এবং এটি প্রতিটি কোষকে ঠিকমতো কাজ করতে নির্দেশনা দেয়। ডিএনএ কোষ বিভাজনের সময় নিজেকে কপি করে নতুন কোষে স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে প্রতিটি নতুন কোষের একই জিনগত তথ্য থাকে।
ডিএনএ টেস্ট কিভাবে করে
ডিএনএ টেস্ট করার জন্য সাধারণত মানুষের শরীরের কোষ ব্যবহার করা হয়, যেমন থুতু, রক্ত, অথবা চুলের মূল। এই নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয় এবং ল্যাবরেটরিতে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। প্রাথমিক ধাপে নমুনা থেকে ডিএনএ বের করা হয় এবং এটি কপি করা হয়। এরপরে ডিএনএ-র নির্দিষ্ট অংশ বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা যায়।
ডিএনএ-র প্রতিটি মানুষের মধ্যে কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে, যা একে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এই কারণে, ডিএনএ-র নমুনা ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ বিশ্লেষণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং কৌশল ব্যবহার করা হয়, যার মাধ্যমে ডিএনএ-র সঠিক মিল নির্ধারণ করা হয়।
ডিএনএ টেস্ট কেন করা হয়
ডিএনএ টেস্ট সাধারণত বিভিন্ন কারণে করা হয়, যার মধ্যে প্রধান কারণ হলো জিনগত সম্পর্ক নির্ধারণ করা। এটি পিতৃত্ব পরীক্ষা, মাতৃত্ব পরীক্ষা, অথবা ভাইবোনের সম্পর্ক নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ডিএনএ টেস্ট অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে সন্দেহভাজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ নমুনা ব্যবহার করা হয়।
ডিএনএ টেস্ট বিভিন্ন রোগের পূর্বাভাস দিতেও ব্যবহৃত হয়। কিছু জিনগত রোগ আছে, যেগুলো পরিবার থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এই রোগের সম্ভাবনা নির্ধারণ করা সম্ভব। এছাড়া, বংশগত রোগের ঝুঁকি নির্ধারণ করতেও ডিএনএ টেস্ট করা হয়। এটি চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণেও সহায়তা করে।
ডিএনএ আমাদের দেহের সবকিছু নির্ধারণ করে এবং আমাদের জীবনের মৌলিক ভিত্তি গঠন করে। এটি আমাদের শরীরের সকল কাজের জন্য নির্দেশনা দেয় এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে। ডিএনএ-র সঠিক গঠন এবং কার্যক্রম জানার মাধ্যমে আমরা জিনগত রোগের পূর্বাভাস পেতে পারি এবং আমাদের জীবনের গঠন এবং আচরণ সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা লাভ করতে পারি। ডিএনএ টেস্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন অপরাধ তদন্ত, জিনগত সম্পর্ক নির্ধারণ এবং চিকিৎসা নির্ধারণে।