আরএনএ কি?
আরএনএ (RNA) বা রাইবোনিউক্লিক এসিড হলো একটি অণু যা জীবের জিনগত তথ্য বহন এবং তার অনুবাদ ও প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি নিউক্লিক এসিড যার মূল কাজ হলো প্রোটিন সংশ্লেষণ এবং বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। ডিএনএ (DNA) থেকে আরএনএ এর পার্থক্য হলো এটি একক স্ট্র্যান্ড বা একক সর্পিল যা সহজে বাঁকানো যায় এবং বিভিন্ন ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
আরএনএ এর পূর্ণরূপ
RNA এর পূর্ণরূপ হলো Ribonucleic Acid। এই নামের মধ্যেই এর গঠন এবং প্রকৃতি লুকিয়ে আছে। রাইবো শব্দটি আসে রাইবোস সুগার থেকে, যা আরএনএ এর প্রধান কাঠামো উপাদান। নিউক্লিক এসিড অর্থ এই যে এটি একটি অ্যাসিড যার মূল কাজ জিনগত তথ্য সংরক্ষণ এবং অনুবাদ করা।
আরও পড়ুনঃ ডিএনএ (DNA) : কি কেন ও কিভাবে
আরএনএ এর গঠন
আরএনএ মূলত চারটি নিউক্লিওটাইড নিয়ে গঠিত: অ্যাডেনিন (A), ইউরাসিল (U), সাইটোসিন (C), এবং গউয়ানিন (G)। ডিএনএ এর মতোই, আরএনএ এরও এক স্ট্র্যান্ড থাকে, তবে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো ডিএনএ তে থাইমিন (T) থাকে, কিন্তু আরএনএ তে থাকে ইউরাসিল। এছাড়া, আরএনএ এর সুগার অংশ হলো রাইবোস, যা ডিএনএ এর ডিঅক্সিরাইবোসের থেকে একটু আলাদা। এর ফলে আরএনএ একটি নমনীয় গঠন প্রাপ্ত হয় যা বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে সক্ষম।
১. অ্যাডেনিন (A)
অ্যাডেনিন হলো একটি পুরিন বেস, যা ডিএনএ এবং আরএনএ উভয় ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। এটি ডিএনএতে থাইমিনের (T) সাথে এবং আরএনএতে ইউরাসিলের (U) সাথে হাইড্রোজেন বন্ডের মাধ্যমে জোড়া তৈরি করে।এটি কার্বন, নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত। অ্যাডেনিনের কাজ হলো জিনগত তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রোটিন তৈরি প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। এটির দ্বারা প্রোটিনের অ্যামিনো এসিডের সঠিক সিকোয়েন্স নির্ধারিত হয়।
২. ইউরাসিল (U)
ইউরাসিল একটি পাইরিমিডিন বেস, যা ডিএনএর পরিবর্তে শুধুমাত্র আরএনএতে পাওয়া যায়। এটি কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত। এটি অ্যাডেনিনের (A) সাথে জোড়া তৈরি করে এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। ইউরাসিলের উপস্থিতি আরএনএর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে এবং বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৩. সাইটোসিন (C)
সাইটোসিন একটি পাইরিমিডিন বেস, যা ডিএনএ এবং আরএনএ উভয় ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। এটি কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত। এটি গউয়ানিনের (G) সাথে জোড়া তৈরি করে। সাইটোসিন জিনগত তথ্যের সংরক্ষণে এবং বংশগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি প্রোটিনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তৈরি করতে সহায়ক।
৪. গউয়ানিন (G)
গউয়ানিন একটি পুরিন বেস, যা ডিএনএ এবং আরএনএ উভয় ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। এটি কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত। এটি সাইটোসিনের (C) সাথে জোড়া তৈরি করে। গউয়ানিন ডিএনএ এবং আরএনএর কাঠামোকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় জিনগত তথ্য বহন করতে সাহায্য করে।
এই চারটি বেস একসাথে মিলিত হয়ে জীবের জিনগত কোড গঠন করে, যা প্রোটিনের সঠিক ধরনের এবং সিকোয়েন্স নির্ধারণে সাহায্য করে।
আরএনএ এর গঠন মূলত তিনটি প্রধান ধরনের হতে পারে: mRNA (messenger RNA), tRNA (transfer RNA) এবং rRNA (ribosomal RNA)। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। mRNA জিনগত তথ্য বহন করে প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য, tRNA অ্যামিনো এসিড সরবরাহ করে এবং rRNA রাইবোজোম গঠন করে।
আরএনএ এর কাজ
আরএনএ এর কাজ বহুমুখী। এটি জীবের জিনগত তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রোটিন সংশ্লেষণে ভূমিকা পালন করে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিবরণ দেওয়া হলো:
১। জিনগত তথ্যের বহনকারী: mRNA ডিএনএ থেকে জিনগত তথ্য গ্রহণ করে রাইবোজোমে নিয়ে যায়।
২। প্রোটিন সংশ্লেষণ: tRNA এর মাধ্যমে অ্যামিনো এসিড প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে। rRNA রাইবোজোম গঠন করে এবং প্রোটিন সংশ্লেষণে সহযোগিতা করে।
৩। জৈব রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: কিছু আরএনএ অণু নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে এবং সেলুলার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
৪। জিনের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ: আরএনএ অনেক সময় জিনের প্রকাশ বা জিনের কাজ কীভাবে হবে তা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
আরএনএ কোথায় থাকে
আরএনএ সাধারণত সেলের নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম এবং রাইবোজোমে পাওয়া যায়। ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিউক্লিয়াসে ঘটে, যা ট্রান্সক্রিপশন নামে পরিচিত। এরপর mRNA সাইটোপ্লাজমে চলে আসে এবং রাইবোজোমে প্রোটিন সংশ্লেষণে অংশগ্রহণ করে।
আরএনএ টেস্ট কেন করা হয়
আরএনএ টেস্ট সাধারণত ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করার জন্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ এর আরএনএ সনাক্তকরণ টেস্ট যা আরটি-পিসিআর (RT-PCR) পদ্ধতির মাধ্যমে করা হয়। আরএনএ টেস্টের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায় কারণ ভাইরাসের আরএনএ একটি নির্দিষ্ট গঠন এবং সিকোয়েন্স অনুসরণ করে, যা টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
আরএনএ টেস্ট কিভাবে করে
আরএনএ টেস্ট করার জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। সাধারণত এটি RT-PCR পদ্ধতির মাধ্যমে করা হয়। প্রথমে রোগীর নাক বা গলার সোয়াব নেওয়া হয়, তারপর স্যাম্পল থেকে আরএনএ সংগ্রহ করা হয়। এরপর আরএনএ এর একটি অনুলিপি তৈরি করা হয় যা cDNA নামে পরিচিত, এবং সেই cDNA কে বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি এবং তার গঠন নির্ণয় করা হয়।
আরএনএ জীবের জিনগত তথ্যের বহনকারী এবং প্রোটিন সংশ্লেষণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি জীববিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অণু যা জীবের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। আরএনএ টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করা যায় এবং এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।