সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা নতুন একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ওজন কমানোর প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। এই আবিষ্কারটি ওজন কমানোর নতুন পদ্ধতি এবং পেশির ক্ষয় রোধের চিকিৎসার নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ইমিউন সিস্টেম দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়ির সাথে যুক্ত থাকে এবং এটি চর্বি জমা রাখা এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। বিশেষ করে যে সমস্ত মানুষদের শিফট ওয়ার্কের কারণে নিয়মিত ঘুম, খাবার খাওয়ার সময়, অথবা কাজের সময়ের পরিবর্তন ঘটে তাদের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বিষয় হতে পারে।
ইমিউন সিস্টেম ও সার্কাডিয়ান রিদমের সংযোগ
সার্কাডিয়ান রিদম হচ্ছে জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যা ২৪ ঘন্টার চক্রের মাধ্যমে কাজ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সময়মতো সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে দেহ বাইরের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, ঘুম এবং জাগ্রত হওয়ার চক্র, যা সূর্যের আলো-অন্ধকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে।
ইমিউন সিস্টেমও সার্কাডিয়ান রিদমের সাথে যুক্ত থাকে, যার ফলে আমাদের দেহ দিনের বিভিন্ন সময়ে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত থাকে। সম্প্রতি গবেষণায় ইমিউন সেলের এই সার্কাডিয়ান রিদমের একটি নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে, যা টিস্যুর কার্যকারিতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে অন্ত্রের ক্ষেত্রে, যেখানে বিশেষায়িত কোষগুলো খাওয়ার সময়ে পুষ্টি শোষণের প্রক্রিয়াটি সর্বাধিক কার্যকর করে তোলে।
আরও পড়ুনঃ ক্যান্সার রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেল যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা
গবেষণার মূল আবিষ্কার
গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে কিছু নির্দিষ্ট ইমিউন কোষ, যা গামা-ডেল্টা টি সেল নামে পরিচিত, ইন্টারলিউকিন-১৭এ (IL-17A) নামে একটি উপাদান তৈরি করে। এই উপাদানটি দেহে চর্বি জমা রাখা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণাটি প্রফেসর লিডিয়া লিঞ্চ এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং এটি প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই টি সেলগুলো “মলিকিউলার ক্লক” জিনের প্রকাশ ঘটায়, যা চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়াকে কার্যকর করে তোলে। সার্কাডিয়ান রিদম সুসমন্বিত থাকলে এই প্রক্রিয়া আরও ভালোভাবে কাজ করে।
গবেষণায় যখন মলিকিউলার ক্লক জিন সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন দেখা গেছে যে চর্বি প্রসেসিং এবং জমা রাখার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এছাড়াও দেহের মেটাবলিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে মেটাবলিক রিদম ব্যাহত হয়েছে এবং মূল দেহ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে।
আধুনিক জীবনের প্রভাব
প্রফেসর লিডিয়া লিঞ্চ আরও বলেন যে আধুনিক জীবনে প্রাকৃতিক ঘুমের সময়সূচি প্রায়ই ব্যাহত হয়। শিফট ওয়ার্ক, স্ক্রিনের নীল আলো, এবং মোবাইল ডিভাইসের ক্রমাগত সংযোগের কারণে আমাদের অনেকেরই স্বাভাবিক ঘুমের সময় নষ্ট হয়ে যায়। যদিও আমরা ক্লান্তি অনুভব করি, তবুও রাতের বেলা অনেকেই দীর্ঘক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রল করতে থাকি। এই ধরনের আচরণ আমাদের সার্কাডিয়ান রিদমকে ব্যাহত করে, যা শরীরে চর্বি জমা রাখা এবং মেটাবলিক প্রক্রিয়ার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ইমিউন সিস্টেমের প্রভাব ও চর্বি জমা রাখা
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে ইমিউন সিস্টেমের সার্কাডিয়ান রিদম কেবল সংক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারলিউকিন-১৭এ (IL-17A) নামক ইমিউন উপাদানটি চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে যখন সার্কাডিয়ান রিদমের সাথে যুক্ত মলিকিউলার ক্লক জিনগুলো ব্যাহত হয়, তখন চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়াও সঠিকভাবে কাজ করে না।
এই গবেষণাটি ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মেটাবলিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে। যদি ইমিউন সিস্টেমের এই উপাদানগুলোকে লক্ষ্য করে ওষুধ তৈরি করা যায়, তাহলে তা ওজন কমানো এবং মেটাবলিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
প্রাথমিক গবেষণার ফলাফল
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে যে যখন মলিকিউলার ক্লক জিনগুলো ইমিউন কোষ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন দেহে চর্বি প্রসেসিং এবং জমা রাখার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এ থেকে বোঝা যায় যে এই জিনগুলো চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়ায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, পুরো দেহের মেটাবলিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে মেটাবলিক রিদম এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।
মেটাবলিক সমস্যা ও আধুনিক জীবনের প্রভাব
গবেষণার ফলাফল থেকে আরও বোঝা যায় যে আমাদের আধুনিক জীবনের নানা প্রভাব, যেমন অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচি এবং বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার, আমাদের ইমিউন সিস্টেম এবং মেটাবলিক প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যারা শিফট ওয়ার্ক করেন বা যাদের কাজের সময় পরিবর্তনশীল, তাদের ক্ষেত্রে সার্কাডিয়ান রিদম ব্যাহত হওয়ার কারণে চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য মেটাবলিক কার্যক্রমে সমস্যা হতে পারে। এটি ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি পেশির ক্ষয় এবং অন্যান্য মেটাবলিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ভবিষ্যতের চিকিৎসার সম্ভাবনা
গবেষণার এই নতুন আবিষ্কারটি ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মেটাবলিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে। ইন্টারলিউকিন-১৭এ (IL-17A) নামক ইমিউন উপাদানটি চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই উপাদানকে লক্ষ্য করে যদি ওষুধ তৈরি করা যায়, তাহলে তা ওজন কমানো এবং পেশির ক্ষয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে ইমিউন কোষের মলিকিউলার ক্লক জিনগুলো সঠিকভাবে কাজ করলে চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় এবং সার্কাডিয়ান রিদমও সুসমন্বিত থাকে। এটি আমাদের ইমিউন সিস্টেম এবং মেটাবলিক প্রক্রিয়ার উপর আধুনিক জীবনের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
এই গবেষণাটি আমাদের আধুনিক জীবনের বিভিন্ন প্রভাব, যেমন শিফট ওয়ার্ক এবং বৈদ্যুতিক ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার, আমাদের দেহের ইমিউন সিস্টেম এবং মেটাবলিক প্রক্রিয়ার উপর কেমন প্রভাব ফেলে তা বোঝাতে সহায়ক। ইমিউন সিস্টেমের সার্কাডিয়ান রিদম এবং ইন্টারলিউকিন-১৭এ (IL-17A) উপাদানের সাহায্যে চর্বি জমা রাখার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এই গবেষণার ফলাফল ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মেটাবলিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।