পদার্থ বিজ্ঞানে বিস্ময়কর আবিষ্কার : একইসঙ্গে কঠিন এবং সুপারফ্লুইড আচরণ

সাম্প্রতিক সময়ে পদার্থবিদরা এক অভূতপূর্ব প্রকারের পদার্থের আবিষ্কার করেছেন, যা একইসঙ্গে কঠিন এবং সুপারফ্লুইড (সুপ্রবাহক) হিসেবে আচরণ করে। এ অবস্থাকে বলা হয় “সুপারসলিড”। প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা এই অবস্থা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছেন, যেখানে কঠিনের গঠন আর তরলের মতো বহমানতার বৈশিষ্ট্য একসাথে বিদ্যমান। এই আবিষ্কার শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে নয়, বরং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সুপারসলিড- এক বিস্ময়কর পদার্থিক অবস্থা

সুপারসলিড পদার্থের এমন এক অবস্থা যা একই সময়ে কঠিন ও সুপারফ্লুইড হিসেবে আচরণ করে। সাধারণত, কঠিন পদার্থ এবং সুপারফ্লুইডের মধ্যে পার্থক্য অনেক। কঠিন পদার্থের একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ও গঠন থাকে, যেখানে সুপারফ্লুইড একটি বিশেষ অবস্থা যার মাধ্যমে এটি কোনো বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে। সুপারসলিড একটি বিশেষ পদার্থিক অবস্থা যেখানে দুটি বৈশিষ্ট্য একত্রিত হয়েছে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

এই আবিষ্কারের বিষয়ে অধ্যাপক ফ্রান্সেসকা ফেরলাইনো ব্যাখ্যা করেছেন যে, “এটি কিছুটা শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো, যা জীবিত এবং মৃত দুটোই একইসাথে। সুপারসলিড একই সাথে কঠিন এবং তরল।” এটি আমাদেরকে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একটি গভীর এবং রহস্যময় দিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনঃ পানির জটিল হাইড্রোজেন বন্ড এর রহস্য উন্মেচন

গবেষণা ও চ্যালেঞ্জের ইতিহাস

সুপারসলিডের গঠন ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষণা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ২০২১ সালে ইনসব্রুকের একটি গবেষণা দল প্রথমবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী দুটি মাত্রার সুপারসলিড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যা ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তারা এর পরবর্তী পর্যায়ে চেষ্টা করছিলেন যাতে এটি ঘূর্ণায়মান অবস্থায় তার গঠন বজায় রাখতে পারে। গবেষণার এই ধাপে আরো বেশি সঠিক ও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়েছিল।

অধ্যাপক ইভা কাসোত্তি ব্যাখ্যা করেছেন যে, “সুপারসলিডকে ঘূর্ণায়মান করা এবং তার অবস্থা ধরে রাখা অনেক বেশি নিখুঁত ও চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল।” গবেষকরা উচ্চমাত্রার সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চুম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে সুপারসলিডকে ঘূর্ণায়মান করেন এবং এই ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়ার ফলে সুপারফ্লুইড অবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্য “কোয়ান্টাইজড ভর্টেক্স” গঠন হতে দেখা যায়।

কোয়ান্টাইজড ভর্টেক্স হল একটি বিশেষ ধরণের ভর্তি, যা সুপারফ্লুইড অবস্থার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই ভর্টেক্সগুলি মূলত তরল পদার্থের অপ্রতিরোধীয় প্রবাহের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষকরা সফলভাবে এই ভর্টেক্সগুলি পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন, যা সুপারফ্লুইড বৈশিষ্ট্যের সরাসরি প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

গবেষণার প্রক্রিয়া

সুপারসলিডের এই গবেষণাটি খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং গবেষকরা তাত্ত্বিক মডেলের সাথে আধুনিক পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি সংমিশ্রিত করে এটি সম্পন্ন করেছেন। ডিপোলার সুপারসলিডে ভর্টেক্স তৈরির প্রক্রিয়া খুবই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। গবেষণার সময় ইনসব্রুকের দলটি প্রায় এক বছর ধরে কাজ করেছে। তারা প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘস্থায়ী দুই মাত্রার সুপারসলিড তৈরি করেছিলেন যা ছিল বিশেষভাবে ঠান্ডা অবস্থায় থাকা এরবিয়াম পরমাণুর গ্যাস। এর পরবর্তী ধাপ ছিল সুপারসলিডের অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত না করে এটিকে ঘূর্ণায়মান করার উপায় বের করা।

গবেষকরা এই কাজ সম্পন্ন করতে তাত্ত্বিক নির্দেশিকা অনুযায়ী চুম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে সুপারসলিডকে সঠিকভাবে ঘূর্ণায়মান করেছেন। কারণ তরল পদার্থ সাধারণত কঠিনের মতো ঘূর্ণায়মান হয় না, বরং এটি সঠিক পদ্ধতিতে না ঘোরালে এটি ভেঙে যেতে পারে। এই বিশেষ ঘূর্ণায়নের ফলে কোয়ান্টাইজড ভর্টেক্স সৃষ্টি হয়, যা সুপারফ্লুইড অবস্থা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

গবেষণার সময় তারা দেখতে পেয়েছেন যে সুপারসলিড এবং অমডুলেটেড কোয়ান্টাম তরলের ভর্টেক্সের গতিশীলতায় একটি বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এটি দেখিয়েছে যে এই বিশেষ কোয়ান্টাম অবস্থায় কঠিন এবং তরল বৈশিষ্ট্যের সহাবস্থান কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত।

মহাকাশীয় সংযোগ ও ভবিষ্যৎ গবেষণা

এই আবিষ্কারের গুরুত্ব শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি মহাকাশ বিজ্ঞান, যেমন নিউট্রন তারার মত ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে। নিউট্রন তারার মধ্যে এমন কোয়ান্টাম অবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে যেখানে সুপারফ্লুইড ভর্টেক্স ফাঁদে পড়ে থাকে। গবেষক থমাস ব্ল্যান্ড ব্যাখ্যা করেছেন, “আমাদের এই প্ল্যাটফর্মটি আমাদেরকে পৃথিবীতেই নিউট্রন তারার মত জটিল প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের সুযোগ দিচ্ছে।”

সমুদ্রের তাপমাত্রা ব্যবধানকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন

নিউট্রন তারার ঘূর্ণায়মান গতির পরিবর্তন, যা “গ্লিচেস” নামে পরিচিত, সুপারফ্লুইড ভর্টেক্স দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সুপারফ্লুইড ভর্টেক্স সুপারকন্ডাক্টরেও বিদ্যমান থাকতে পারে, যা কোনো বিদ্যুৎশক্তি ক্ষতি ছাড়াই পরিবাহিত করতে পারে। গবেষকরা আশা করছেন যে তাদের এই প্ল্যাটফর্মটি নতুন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার নতুন পথ উন্মোচন করবে এবং এমন কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে দেবে যা প্রকৃতিতে শুধুমাত্র চরম অবস্থায় ঘটে।

অধ্যাপক ফ্রান্সেসকা ফেরলাইনো বলেন, “আমাদের কাজটি নতুন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আমরা এখানে পরীক্ষাগারে এমন কিছু পদার্থবিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ করতে পারি যা প্রকৃতিতে শুধুমাত্র চরম অবস্থায়, যেমন নিউট্রন তারার মধ্যে ঘটে।”

এই গবেষণা সুপারসলিডের মতো বিরল এবং চমকপ্রদ পদার্থিক অবস্থার ভবিষ্যৎ প্রয়োগ সম্পর্কে নতুন ধারণা এবং প্রভাব ফেলতে সাহায্য করবে। এটি কেবল পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নয়, বরং মহাকাশ বিজ্ঞান এবং অন্যান্য কোয়ান্টাম সিস্টেমের গবেষণায়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো