মহাকাশের বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনা আমাদের বিস্মিত করে। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা আবিষ্কার করা হয়েছে যেখানে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল একটি তারা (স্টার) ধ্বংস করে সেই তারার ধ্বংসাবশেষ দিয়ে আরেকটি তারাকে আঘাত করছে। এই ঘটনাটি আমাদের ব্ল্যাক হোলের পরিবেশ এবং এর কার্যকলাপ সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটি বিজ্ঞানীদের মহাজাগতিক ঘটনা, যেমন টিডিই (টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্ট) এবং কিউপিই (কোয়াসি-পিরিয়ডিক ইরাপশন) সম্পর্কে নতুন ধারনা এনে দিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা এই ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ব্ল্যাক হোলের ধ্বংসাত্মক আচরণ
নাসার চান্দ্রা এক্স-রে অবজারভেটরি ও অন্যান্য টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল একটি তারাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে এবং সেই ধ্বংসাবশেষের সাহায্যে অন্য একটি বস্তু, যা সম্ভবত আরেকটি তারা অথবা একটি ছোট ব্ল্যাক হোল, আঘাত করছে। এই ঘটনার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দুটি পূর্বে আলাদা ঘটনা, যেমন টিডিই এবং কিউপিই-এর মধ্যে সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। এটি মহাকাশের বৃহত্তম কিছু ব্ল্যাক হোলের আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে নতুন ধারণা এনে দিয়েছে।
চিত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে ব্ল্যাক হোল একটি তারাকে তার প্রবল আকর্ষণ শক্তি দিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে এবং সেই ধ্বংসাবশেষ দিয়ে একটি বড় ডিস্ক তৈরি করে। কয়েক বছর ধরে এই ডিস্কটি বিস্তৃত হতে হতে আরেকটি কক্ষপথে থাকা বস্তুটির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। প্রতিবার এই সংঘর্ষের ফলে এক্স-রে বিস্ফোরণ ঘটে, যা চান্দ্রা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় কণা অ্যাক্সিয়নের সন্ধান পেয়েছে বিজ্ঞানীরা
টিডিই এর আবিষ্কার
২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি অপটিক্যাল টেলিস্কোপের মাধ্যমে একটি আলোর ঝলক দেখা যায়, যা পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা একটি ‘টিডিই’ বা ‘টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই ঘটনা ঘটে যখন একটি ব্ল্যাক হোল তার প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিয়ে একটি তারাকে ধ্বংস করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা এই টিডিই-এর নাম দিয়েছেন “AT2019qiz”।
এদিকে, বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব জুড়ে অন্য এক ধরনের মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন, যেগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত এবং নিয়মিত এক্স-রে বিস্ফোরণ, যা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি দেখা যায়। এই ঘটনাগুলোকে ‘কোয়াসি-পিরিয়ডিক ইরাপশন’ বা কিউপিই বলা হয়।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো দেখায় যে টিডিই এবং কিউপিই-এর মধ্যে সম্ভাব্য সংযোগ থাকতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, টিডিই-এর পর তৈরি হওয়া ডিস্কের সাথে কোনো বস্তুর সংঘর্ষেই এই কিউপিই ঘটে। যদিও আরও কিছু কারণ থাকতে পারে, গবেষণার লেখকগণ মনে করেন যে এ ধরনের সংঘর্ষই অন্তত কিছু কিউপিই-এর জন্য দায়ী।
চান্দ্রা এবং হাবলের পর্যবেক্ষণ
২০২৩ সালে, বিজ্ঞানীরা চান্দ্রা এবং হাবল উভয়কেই ব্যবহার করে টিডিই-এর পরে অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষের ওপর একসাথে গবেষণা করেন। চান্দ্রার ডেটা তিনটি আলাদা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়, যার প্রতিটি পর্যবেক্ষণের মধ্যে প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা ব্যবধান ছিল। মোট ১৪ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে প্রথম এবং শেষ পর্যবেক্ষণে খুব দুর্বল সংকেত পাওয়া যায়, কিন্তু মধ্যবর্তী পর্যবেক্ষণে খুব শক্তিশালী সংকেত পাওয়া যায়।
এরপর, বিজ্ঞানীরা নাসার নিউট্রন স্টার ইন্টেরিয়র কম্পোজিশন এক্সপ্লোরার (NICER) ব্যবহার করে AT2019qiz-এ বারবার এক্স-রে বিস্ফোরণের জন্য পর্যবেক্ষণ চালান। NICER-এর তথ্য দেখায় যে AT2019qiz প্রায় প্রতি ৪৮ ঘন্টায় একবার বিস্ফোরিত হয়। নাসার নীল গেহরেলস সুইফট অবজারভেটরি এবং ভারতের অ্যাস্ট্রোস্যাট টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ এই ফলাফলকে আরও দৃঢ় করে।
আলট্রাভায়োলেট পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য
একই সময়ে চান্দ্রার পর্যবেক্ষণের সময় হাবল থেকে প্রাপ্ত আলট্রাভায়োলেট ডেটা বিজ্ঞানীদের ব্ল্যাক হোলের চারপাশের ডিস্কের আকার নির্ধারণে সাহায্য করে। তারা দেখেছেন যে এই ডিস্কটি এত বড় হয়ে গেছে যে যদি কোনো বস্তু ব্ল্যাক হোলের চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে এক সপ্তাহ বা তার কম সময় নেয়, তবে সেটি এই ডিস্কের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
এই ফলাফলটির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও কিউপিই খুঁজে পাওয়ার আশা করা হচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চারপাশের কক্ষপথে থাকা বস্তুর বিস্তার এবং দূরত্ব পরিমাপে সাহায্য করবে। এর কিছু বস্তু ভবিষ্যতের পরিকল্পিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণাগারগুলোর জন্য চমৎকার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে লেখা নিবন্ধটি ২০২৪ সালের ৯ই অক্টোবর তারিখে ‘ন্যাচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণার প্রধান লেখক হলেন কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের ম্যাট নিকোল।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর মাধ্যমে তোলা গ্যালাক্সির বৃহত্তম “সুপার স্টার ক্লাস্টার” এর ছবি