মহাবিশ্বের বিস্তার নিয়ে গবেষণার মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। মহাবিশ্বের বিস্তার কেন ত্বরান্বিত হচ্ছে—এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বৃহৎ ধাঁধা হিসেবে রয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর নতুন করে আলোকপাত করেছেন। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব জেনেভা (UNIGE) এবং টুলুজ III – পল সাবাতিয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ডার্ক এনার্জি সার্ভে (Dark Energy Survey) থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বের পূর্বাভাসের সাথে তুলনা করেছেন। তারা মহাবিশ্বের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে একটি ছোট অমিল খুঁজে পেয়েছেন। এই অমিল মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেলে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের বড় বড় বস্তুসমূহ স্থান এবং সময়কে বিকৃত করে, ঠিক যেমন একটি ভারী বস্তু একটি নমনীয় পৃষ্ঠকে নিচু করে ফেলে। এই বিকৃতির ফলে মহাকর্ষীয় শক্তির প্রভাব তৈরি হয়, যার মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহ এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তুগুলো তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। যখন আলো এই বিকৃত মহাকাশের মধ্যে দিয়ে চলাচল করে, তখন তার পথও বাঁকা হয়ে যায়। এটি “মহাকর্ষীয় লেন্সিং” নামে পরিচিত। প্রথমবারের মতো ১৯১৯ সালে এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল এবং এটি আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা প্রমাণ করেছিল। এই পর্যবেক্ষণটি ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন এবং ফ্রাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল। তারা দেখিয়েছিলেন যে সূর্যের মহাকর্ষীয় শক্তি দূরবর্তী নক্ষত্রের আলোর পথকে বাঁকিয়ে দিয়েছিল, যা আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে মিলে যায়।
আরও পড়ুনঃ পদার্থ বিজ্ঞানে বিস্ময়কর আবিষ্কার : একইসঙ্গে কঠিন এবং সুপারফ্লুইড আচরণ
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বিস্তার এবং এর গতি সম্পর্কিত নতুন তথ্য সংগ্রহ করছেন। বিশেষ করে ডার্ক এনার্জি সার্ভে থেকে প্রাপ্ত ডেটা ব্যবহার করে তাঁরা মহাকাশের মহাকর্ষীয় বিকৃতির পরিমাপ করেছেন এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে তার তুলনা করেছেন। এটি মহাবিশ্বের মধ্যে শক্তির, বস্তুর, এবং গতির অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বোঝার জন্য সহায়ক। মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেলে এই তত্ত্বের সঠিকতা যাচাই করা হচ্ছে, যা আইনস্টাইনের তত্ত্বের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গবেষকরা ১০০ মিলিয়ন গ্যালাক্সির ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন, যা মহাবিশ্বের বিস্তার এবং তার বিকৃতির গতিপথের ওপর আলোকপাত করেছে। এই গবেষণায় মহাবিশ্বের ৩.৫, ৫, ৬ এবং ৭ বিলিয়ন বছর পূর্বের বিস্তার পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে অতীতের মহাবিশ্বে মহাকর্ষীয় “ওয়েল” বা গহ্বরগুলোর গভীরতা আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে মিলে গেছে, তবে বর্তমানে, বিশেষ করে ৩.৫ থেকে ৫ বিলিয়ন বছর আগে, এই গহ্বরগুলোর গভীরতা কিছুটা কম ছিল, যা আইনস্টাইনের তত্ত্বের পূর্বাভাসের সাথে কিছুটা অমিল।
এই সময়েই মহাবিশ্বের বিস্তার ত্বরান্বিত হওয়া শুরু করে। গবেষকদের মতে, এই অমিল সম্ভবত মহাবিশ্বের বিস্তার ত্বরান্বিত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত। মহাকর্ষ হয়তো বড় পরিসরে আইনস্টাইনের পূর্বাভাসের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করে থাকতে পারে। ডার্ক এনার্জি, যা মহাবিশ্বের বিস্তার ত্বরান্বিত করে বলে ধারণা করা হয়, তার ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ডার্ক এনার্জি এমন একটি অদৃশ্য শক্তি, যা মহাবিশ্বের বিস্তারকে প্রভাবিত করে এবং এটি মহাকর্ষের সাথে সম্পর্কিত কোনো নতুন নিয়ম হতে পারে।
গবেষকদের মতে, আইনস্টাইনের তত্ত্ব এবং নতুন পর্যবেক্ষণের মধ্যে ৩ সিগমা (sigma) পর্যন্ত অমিল রয়েছে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এই ধরনের অমিল আকর্ষণীয় এবং তা নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। তবে এই অমিল আইনস্টাইনের তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণ করতে যথেষ্ট নয়। এটি প্রমাণ করতে হলে ৫ সিগমা অমিল প্রয়োজন। তাই গবেষকরা মনে করেন যে, আরও নিখুঁত এবং সঠিক পরিমাপের প্রয়োজন, যাতে এই অমিলের সত্যতা যাচাই করা যায় এবং আইনস্টাইনের তত্ত্ব মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসরে কতটুকু প্রযোজ্য তা বোঝা যায়।
গবেষণা দলের সদস্যরা বর্তমানে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই টেলিস্কোপটি মহাকাশ থেকে মহাবিশ্বের বিকৃতির তথ্য সংগ্রহ করবে এবং তা আরও নিখুঁতভাবে পরিমাপ করবে। ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপ আগামী ছয় বছরে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন গ্যালাক্সির ডেটা সংগ্রহ করবে, যা মহাবিশ্বের ইতিহাসের আরও গভীরে অনুসন্ধান করতে এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা পরীক্ষা করতে সহায়ক হবে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, মহাবিশ্বের বিস্তার এবং এর আচরণ নিয়ে নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছে, যা ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। আইনস্টাইনের তত্ত্ব মহাকর্ষীয় বিকৃতি এবং মহাবিশ্বের বিস্তার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করেছে, তবে এই নতুন গবেষণার মাধ্যমে কিছু অমিল শনাক্ত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
মহাবিশ্বের বিস্তার এবং তার প্রকৃতির উপর নতুন তথ্য সংগ্রহের জন্য এই ধরনের গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে, নতুন ডেটা এবং আরও সঠিক পরিমাপের মাধ্যমে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব হবে। এই গবেষণা আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং তার গতিশীলতা সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা প্রদান করবে।
এই পর্যবেক্ষণগুলো বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের গতিশীলতা এবং তার বিস্তারের নিয়ম বুঝতে সাহায্য করছে। মহাবিশ্বের বিশাল পরিসরে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা যাচাই করা এবং এর ব্যতিক্রম খুঁজে বের করা বর্তমান বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত ডেটা এবং আরও গভীর গবেষণার মাধ্যমে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঠিকতা চূড়ান্তভাবে যাচাই করা যাবে। যদি এই তত্ত্বের মধ্যে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে এবং তা পরিবর্তিত হয়, তবে তা বিশ্ব বিজ্ঞান ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তন আনবে।