প্রকৃতিতে বিভিন্ন জীবের মধ্যে এমন কিছু গুণাবলী আছে, যা মানুষের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও নতুন দিক খুলে দিতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে হার্ট-শেপড ক্ল্যাম বা হৃদয় আকৃতির শামুক তাদের খোলসে এমন কিছু ফাইবার অপটিক্সের মতো গঠন ব্যবহার করে, যা সূর্যের আলোকে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালিত করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে তারা সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে তাদের শরীরে থাকা অ্যালগি বা শৈবালের পুষ্টি সংগ্রহে সহায়তা করে। এই গবেষণা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য একটি নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
এই হার্ট-শেপড শামুকগুলোকে ইংরেজিতে “হার্ট ককেলস” (Corculum cardissa) বলা হয়, এবং এগুলো ইন্ডিয়ান ও প্যাসিফিক মহাসাগরের অগভীর পানিতে পাওয়া যায়। এই শামুকগুলো তাদের শরীরে শৈবাল ধারণ করে এবং সেই শৈবালকে সূর্যের আলো দিয়ে পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সেই শৈবালও শামুকগুলোকে প্রয়োজনীয় শর্করা ও পুষ্টি সরবরাহ করে। এই সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে শামুক ও শৈবালের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুনঃ অদ্ভুত লেজার রশ্মি, যে নিজের আলোর ছায়া তৈরি করে
হার্ট ককেলসের শামুকের খোলসের বিশেষ গঠন তাদের আলো পরিবহন করতে সাহায্য করে। এদের খোলসে ছোট ছোট স্বচ্ছ “উইন্ডো” বা জানালার মতো অংশ থাকে, যা সূর্যের আলোকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়। খোলসের গঠনে রয়েছে অ্যারাগোনাইট নামক এক ধরনের বিশেষ ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের স্ফটিক। এই অ্যারাগোনাইট স্ফটিকগুলো মাইক্রন আকারের ছোট ছোট নল হিসেবে সাজানো থাকে, যা ফাইবার অপটিক্স ক্যাবলের মতো কাজ করে। এগুলো সূর্যের আলোকে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালিত করে এবং ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মিকে ফিল্টার করে ফেলে, যা শামুকের শরীর ও শৈবালের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর গবেষক ডাকোটা ম্যাককয় এবং তার সহকর্মীরা মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, শামুকের খোলসের সূর্য-সম্মুখ অংশ প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ফটোসিনথেসিসের জন্য প্রয়োজনীয় আলো ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়, অথচ ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মিকে অধিকাংশ সময় বাইরে রাখে। এ কারণে শামুকগুলো ব্লিচিং বা বিবর্ণ হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে, যা বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, শামুকের খোলসের ফাইবার অপটিক্সের মতো গঠন তাদের শক্তিশালী এবং আলো প্রবাহের জন্য উপযোগী করার ক্ষেত্রে একটি সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখে। হার্ট ককেলসের শামুকগুলো বিশেষ ধরণের খনিজ উপাদান ব্যবহার করে আলো প্রবাহিত করে, যেখানে অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বিশাল ক্ল্যাম বা শামুক তাদের শরীরের বিশেষ কোষ ব্যবহার করে আলো প্রবাহিত করে। এটি শামুকগুলোর একটি বিশেষ উন্নয়ন, যা শুধুমাত্র খোলসের গঠনকে কাজে লাগিয়ে আলোর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এই গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, অ্যারাগোনাইটের বিশেষ গঠন আলোকে প্রতিফলিত করার জন্য কোন প্রলেপের প্রয়োজন ছাড়াই আলোর সংকেতগুলোকে সঠিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম। বর্তমানে টেলিকমিউনিকেশন ক্যাবলে আলোর প্রবাহ সীমাবদ্ধ রাখার জন্য প্রতিফলনকারী প্রলেপের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অ্যারাগোনাইট স্বাভাবিকভাবেই এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। গবেষকরা মনে করছেন, অ্যারাগোনাইটের এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের অপটিক্যাল উপাদান তৈরি করা সম্ভব, যা ভবিষ্যতে ওয়্যারলেস যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং উন্নত পরিমাপ যন্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
এই গবেষণায় পাওয়া ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে, প্রকৃতির বিভিন্ন জৈবিক উপাদান এবং গঠন আমাদের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা দিতে পারে। হার্ট ককেলসের শামুকের খোলস থেকে প্রাপ্ত ফাইবার অপটিক্সের মতো গঠনের আদলে ভবিষ্যতে উন্নত আলো সংগ্রহের সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। কিং আব্দুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক বুন উয়ি বলেছেন, “হার্ট ককেলসের ফাইবার বান্ডলিংয়ের মতো গঠন অনুকরণ করে আমরা উন্নত আলো সংগ্রহের সিস্টেম তৈরি করতে পারি।”
গবেষক ডাকোটা ম্যাককয় বলেছেন, “বিলিয়ন বছর ধরে প্রকৃতি এই উন্নয়ন করেছে। এই শামুকের খোলসের নকশা থেকে আমরা আলোক সংবহন ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় পেতে পারি, যা আমাদের প্রযুক্তিগত ব্যবহারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে।” এ ধরনের উদ্ভাবন মানুষকে যেমন ইন্টারনেট প্রযুক্তির উন্নয়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি প্রকৃতির নানা বৈশিষ্ট্যও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ পদার্থ বিজ্ঞানে বিস্ময়কর আবিষ্কার : একইসঙ্গে কঠিন এবং সুপারফ্লুইড আচরণ