চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য জানালো বিজ্ঞানীরা

চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে অনেক বছর ধরে বৈজ্ঞানিক মহলে বিতর্ক চলছিল। চাঁদের অভ্যন্তরীণ কোরটি আসলে কঠিন নাকি তরল—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে বহু দিন ধরে। কিন্তু ২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অবশেষে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। এই গবেষণায় দেখা গেছে যে চাঁদের অন্তঃকোর আসলে একটি কঠিন বল, যার ঘনত্ব লোহা বা আয়রনের মতো। এই আবিষ্কার চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে এবং চাঁদের ইতিহাস ও আমাদের সৌরজগতের গঠনের একটি পরিষ্কার চিত্র পেতে সাহায্য করবে।

গবেষক দলটির মতে, চাঁদের অভ্যন্তরীণ কোরের এই আবিষ্কার চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্রের বিবর্তনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। চাঁদের অভ্যন্তরে যে একটি কঠিন কোর আছে, তা চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি ও তার বিবর্তন নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে। এই গবেষণা থেকে জানা যায় যে, চাঁদের অভ্যন্তরে একটি গ্লোবাল ম্যান্টল ওভারটর্ন অর্থাৎ স্তর পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, যা চাঁদের প্রথম এক বিলিয়ন বছরের সময়কালীন ঘটনাগুলোর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।

আরও পড়ুনঃ ১১ বিলিয়ন বছরের মহাকাশ ইতিহাসের তত্ত্ব প্রকাশ করেছে ডিইএসআই (DESI)

সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ এবং উপগ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন নির্ধারণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ভূমিকম্পীয় (সিসমিক) তথ্য সংগ্রহ করা। যেকোনো গ্রহ বা উপগ্রহের অভ্যন্তরে সংঘটিত ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলো কিভাবে অভ্যন্তরীণ স্তরের মধ্যে সঞ্চালিত হয় এবং প্রতিফলিত হয়, তা থেকে বিজ্ঞানীরা ওই গ্রহ বা উপগ্রহের অভ্যন্তরের একটি বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করতে পারেন। চাঁদের ক্ষেত্রেও এমনটাই করা হয়েছে। অ্যাপোলো মিশনের সময় সংগ্রহ করা সিসমিক তথ্য থেকে আমরা চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। তবে সেই তথ্যের রেজোলিউশন বা স্পষ্টতা কম থাকায় চাঁদের অভ্যন্তরীণ কোরের প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছিল না। আমরা জানি যে চাঁদের একটি তরল বাইরের কোর আছে, তবে এর ভেতরে কী রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। অ্যাপোলো মিশনের তথ্য দিয়ে তৈরি করা মডেলে কঠিন কোর এবং সম্পূর্ণ তরল কোর উভয়ই মানানসই ছিল।

এবারের গবেষণায়, ফরাসি গবেষক আর্থার ব্রিয়োড এবং তার সহকর্মীরা বিভিন্ন মহাকাশ মিশন এবং চাঁদের লেজার রেঞ্জিং পরীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করেন, যা থেকে চাঁদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের একটি প্রোফাইল তৈরি করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সাথে এর পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপে এর বিকৃতি, পৃথিবী থেকে এর দূরত্বের পরিবর্তন এবং এর ঘনত্ব। এরপর তারা বিভিন্ন কোর মডেলের সাথে এই তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখেন, যাতে চাঁদের প্রকৃত গঠন সম্পর্কে জানা যায়।

গবেষকরা দেখতে পান যে চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে যে মডেলটি সবচেয়ে কাছাকাছি মিলে, তা হলো একটি সক্রিয় স্তর পরিবর্তন মডেল। এই মডেল অনুযায়ী, চাঁদের অভ্যন্তরে ঘন পদার্থ কেন্দ্রের দিকে নিচে পড়ে যায় এবং কম ঘন পদার্থ উপরে উঠে আসে। অনেকদিন ধরে চাঁদের আগ্নেয়গিরি এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু মৌল পাওয়ার জন্য এই ধরনের অভ্যন্তরীণ স্তর পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়ে আসছিল। গবেষক দলটির কাজ এই প্রস্তাবকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।

তাদের মডেল অনুযায়ী চাঁদের কোর অনেকটা পৃথিবীর কোরের মতো। এর বাইরের কোরটি তরল এবং ভেতরের কোরটি কঠিন। বাইরের কোরটির ব্যাসার্ধ প্রায় ৩৬২ কিলোমিটার এবং ভেতরের কোরটির ব্যাসার্ধ প্রায় ২৫৮ কিলোমিটার। এটি চাঁদের মোট ব্যাসার্ধের প্রায় ১৫ শতাংশ। ভেতরের কোরটির ঘনত্ব প্রায় ৭,৮২২ কিলোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার, যা আয়রনের ঘনত্বের খুব কাছাকাছি।

এবার এলিয়েনের খোঁজে নাসার নতুন রোমান টেলিস্কোপ তৈরি

কৌতূহলজনকভাবে, ২০১১ সালে নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের গবেষক রেনে ওয়েবারের নেতৃত্বে করা এক গবেষণায়ও একই ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছিল। সেই গবেষণায় অ্যাপোলো মিশনের সিসমিক তথ্য ব্যবহার করে চাঁদের কোর নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। ওই গবেষণায় চাঁদের কঠিন অন্তঃকোরের ব্যাসার্ধ প্রায় ২৪০ কিলোমিটার এবং ঘনত্ব প্রায় ৮,০০০ কিলোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার বলে ধারণা করা হয়েছিল। ব্রিয়োড এবং তার দল বলছেন যে তাদের গবেষণার ফল ওই আগের গবেষণারই একটি পুনরায় নিশ্চিতকরণ, এবং এটি পৃথিবীর মতো চাঁদের কোরের অস্তিত্বের একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

এই আবিষ্কার চাঁদের বিবর্তনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা জানি যে চাঁদ গঠিত হওয়ার কিছুদিন পর এর একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ছিল, যা প্রায় ৩.২ বিলিয়ন বছর আগে কমে যেতে শুরু করে। একটি চৌম্বক ক্ষেত্র মূলত কোরের অভ্যন্তরে গতিবিধি এবং সঞ্চালনের মাধ্যমে তৈরি হয়। তাই চাঁদের কোর কী দিয়ে গঠিত, তা এর চৌম্বক ক্ষেত্রের বিবর্তন সম্পর্কে জানার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা আশা করছেন যে এই নতুন তথ্য চাঁদের বিবর্তনের ইতিহাস এবং এর চৌম্বক ক্ষেত্রের বিবর্তন সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করবে।

এছাড়া, চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠনের বিষয়ে এই গবেষণা চাঁদের অতীত এবং সৌরজগতের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের আরও ভালো ধারণা পেতে সহায়ক হবে। চাঁদের কোরের প্রকৃতি সম্পর্কে এই নতুন আবিষ্কার আমাদেরকে চাঁদের ভবিষ্যৎ গবেষণা এবং আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশীর গঠন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে সহায়তা করবে।

আরও পড়ুনঃ পৃথিবীতে জীবনের শুরু কীভাবে হলো? বিজ্ঞানীরা এবার নতুন এক তথ্য খোঁজে পেলো

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো