অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে আলোর মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করে জানুন কি কেন ও কিভাবে?

অপটিক্যাল ফাইবার কি?

অপটিক্যাল ফাইবার একটি আধুনিক প্রযুক্তি যা আলোক সংকেতের মাধ্যমে ডেটা স্থানান্তরের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণ তারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় যেখানে ইলেকট্রিক্যাল সংকেতের পরিবর্তে আলোক সংকেত ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তি বর্তমানে ইন্টারনেট, টেলিকমিউনিকেশন এবং বিভিন্ন ধরনের ডেটা ট্রান্সমিশন সিস্টেমে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অপটিক্যাল ফাইবার উচ্চ গতির ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম।

অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তির ইতিহাস

অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তির প্রথম ধারণাটি উনিশ শতকের শেষের দিকে উদ্ভাবিত হয়। ১৮৮০ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল “ফোটোফোন” নামে একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যা আলো ব্যবহার করে শব্দ পরিবহনে সক্ষম ছিল। এই যন্ত্রটি যদিও বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিল না, তবে এটি আলোক সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। আধুনিক অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তি ১৯৬০-এর দশকে বিকশিত হয়। ১৯৬৬ সালে চার্লস কে’ কাও এবং জর্জ হকের গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে কাচের ফাইবার ব্যবহার করে দীর্ঘ দূরত্বে আলোক সংকেত প্রেরণ করা সম্ভব। চার্লস কাও প্রমাণ করেছিলেন যে কাচের বিশুদ্ধতা বাড়িয়ে এটি কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই গবেষণা তাদের নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। ১৯৭০-এর দশকে কর্নিং গ্লাস ওয়ার্কস কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য অপটিক্যাল ফাইবার তৈরি করে, যা এই প্রযুক্তিকে বিপ্লবী করে তোলে।

আরও পড়ুনঃ টাইম মেশিন তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব ? কি কেন ও কিভাবে

অপটিক্যাল ফাইবার এর গঠন

অপটিক্যাল ফাইবার মূলত তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত।

১। কোর: অপটিক্যাল ফাইবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর কোর। এটি উচ্চমানের কাচ বা কখনও কখনও বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। কোরটি খুবই সরু এবং এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে আলো বারবার প্রতিফলিত হতে পারে এবং কোরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই প্রক্রিয়াকে টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশন বলা হয়। কোরের গুণগত মান সরাসরি ডেটা ট্রান্সমিশনের গতি এবং মানের ওপর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি কোর সাধারণত স্বল্প দূরত্বের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন স্থানীয় নেটওয়ার্ক বা বাড়ির অভ্যন্তরীণ সংযোগ। অপরদিকে, কাচ দিয়ে তৈরি কোর দীর্ঘ দূরত্ব এবং উচ্চ গতির ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য উপযোগী।

২। ক্ল্যাডিং: ক্ল্যাডিং হলো অপটিক্যাল ফাইবারের একটি অপরিহার্য স্তর, যা কোরের চারপাশে থাকে। এটি আলোক সংকেতকে কোরের বাইরে যেতে বাধা দেয় এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে সংকেতকে কোরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। ক্ল্যাডিং এমন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় যার অপটিক্যাল ঘনত্ব কোরের চেয়ে কম, যা আলোর প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করে। সাধারণত এটি কোরের সাথে একটি নিখুঁতভাবে সংযুক্ত স্তর হিসেবে কাজ করে এবং কোর থেকে সংকেতের অপচয় কমায়। এই স্তরটি ফাইবারের সামগ্রিক কার্যকারিতা এবং ডেটা ট্রান্সমিশনের মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩। প্রটেকটিভ কোটিং: এটি অপটিক্যাল ফাইবারের বাইরের স্তর, যা ফাইবারকে বাহ্যিক ক্ষতি, আর্দ্রতা এবং যান্ত্রিক চাপ থেকে রক্ষা করে। প্রটেকটিভ কোটিং সাধারণত শক্ত এবং নমনীয় উপাদান দিয়ে তৈরি, যেমন পলিমার বা রাবার, যা ফাইবারকে টেকসই এবং পরিবেশগত প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখে। এটি শুধু ফাইবারকে সুরক্ষিত রাখে না, বরং ফাইবার ইনস্টলেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়াকেও সহজ করে তোলে। বিভিন্ন পরিবেশে ব্যবহারের উপযোগী করতে এই স্তরটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আর্দ্র বা রাসায়নিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল পরিবেশে ফাইবার ব্যবহার করার সময় প্রটেকটিভ কোটিং আরও সুরক্ষামূলক বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়।

পৃথিবীর এমন কিছু অদ্ভুত জায়গা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না!

অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে কাজ করে ?

অপটিক্যাল ফাইবার এর কার্যপ্রণালী বোঝার জন্য নিচের ধাপগুলো বিশ্লেষণ করা হলো:

১। ডেটা সংকেত তৈরি: প্রথমে একটি লেজার বা এলইডি আলোক উৎস থেকে ডেটাকে আলোক সংকেতে রূপান্তর করা হয়। ডেটা মূলত বাইনারি কোড হিসেবে থাকে, যেমন ০ এবং ১। এই আলোক সংকেত ফাইবারের মাধ্যমে প্রেরণ করার জন্য বিশেষভাবে প্রক্রিয়াকৃত হয়। লেজার সাধারণত দীর্ঘ দূরত্ব এবং উচ্চ গতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি একত্রিত এবং শক্তিশালী আলোক রশ্মি তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে, এলইডি সস্তা এবং স্বল্প দূরত্বের জন্য উপযুক্ত। আলোক উৎস থেকে নির্গত সংকেতের মড্যুলেশন প্রক্রিয়ায় ডেটাকে এমনভাবে রূপান্তর করা হয় যে এটি কোরে প্রতিফলিত হতে পারে এবং নিখুঁতভাবে প্রেরিত হয়।

২। আলোক সংকেতের প্রবাহ: আলোক সংকেত ফাইবারের কোর দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেখানে ক্ল্যাডিং কোরের চারপাশে একটি প্রতিফলক স্তর হিসেবে কাজ করে। ক্ল্যাডিং-এর কারণে আলো কোরের বাইরে বের হতে পারে না এবং অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলনকে টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশন বলা হয়, যা আলোক সংকেতকে কোরের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংকেত দীর্ঘ দূরত্ব পর্যন্ত অক্ষত থাকে এবং শক্তির ক্ষয় খুব কম হয়। এছাড়া, ক্ল্যাডিং-এর মাধ্যমে অপচয় রোধ করার কারণে ফাইবারের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। সংকেতের এই সুষ্ঠু প্রবাহই অপটিক্যাল ফাইবারকে দীর্ঘ দূরত্বে ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য আদর্শ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৩। সংকেত গ্রহণ: ফাইবারের অপর প্রান্তে একটি রিসিভার স্থাপন করা হয়, যা আলোক সংকেতকে পুনরায় ইলেকট্রিক্যাল সংকেতে রূপান্তর করার জন্য দায়ী। রিসিভারটি সাধারণত ফটোডিটেক্টর ব্যবহার করে কাজ করে, যা আলোক শক্তিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং সংকেতের মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। রিসিভারটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে সংকেতের ক্ষতি কম হয় এবং সঠিক ডেটা পুনরুদ্ধার করা যায়। একবার সংকেত বৈদ্যুতিক আকারে রূপান্তরিত হলে, এটি প্রসেসিং বা সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত হয়। এই ধাপটি অপটিক্যাল ফাইবার সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দ্রুত এবং নির্ভুল ডেটা ট্রান্সমিশন নিশ্চিত করে।

অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য

  • উচ্চ ব্যান্ডউইডথ: অপটিক্যাল ফাইবার প্রচুর পরিমাণে ডেটা স্থানান্তর করতে সক্ষম। এটি কয়েক জিবিপিএস (Gbps) পর্যন্ত গতি সরবরাহ করতে পারে।
  • দীর্ঘ দূরত্বে কার্যকর: অপটিক্যাল ফাইবার দীর্ঘ দূরত্বে সংকেত প্রেরণে অত্যন্ত কার্যকর। এতে সংকেতের ক্ষয়প্রাপ্তি খুবই কম।
  • তড়িৎ চৌম্বকীয় হস্তক্ষেপ মুক্ত: কারণ এটি ইলেকট্রিক্যাল সংকেত ব্যবহার করে না, তাই এটি তড়িৎ চৌম্বকীয় হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
  • হালকা ওজন: এটি কপার তারের তুলনায় হালকা, যা এটি পরিবহন ও স্থাপনে সহজ করে তোলে।
  • উচ্চ সুরক্ষা: অপটিক্যাল ফাইবার থেকে ডেটা চুরি করা অত্যন্ত কঠিন, যা এটি নিরাপদ যোগাযোগের জন্য আদর্শ করে তোলে।

অপটিক্যাল ফাইবার এর ব্যবহার

অপটিক্যাল ফাইবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

  • ইন্টারনেট সংযোগ: অপটিক্যাল ফাইবার উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানে ব্যবহৃত হয়। ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক (FTTH) প্রযুক্তি বর্তমানে শহরাঞ্চলে দ্রুত ইন্টারনেট সরবরাহ করছে।
  • টেলিকমিউনিকেশন: টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে অপটিক্যাল ফাইবার ফোন কল এবং ডেটা স্থানান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আন্তর্জাতিক কল এবং ডেটা ট্রান্সমিশনে ব্যবহৃত হয়।
  • কেবল টিভি: অপটিক্যাল ফাইবার কেবল টিভি সিগন্যাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়, যা উন্নত মানের ভিডিও ও অডিও সিগন্যাল সরবরাহ করে।
  • চিকিৎসা: এন্ডোস্কোপি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামে অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহৃত হয়। এটি চিকিৎসকদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশ পর্যালোচনায় সাহায্য করে।
  • সামরিক ও মহাকাশ: সামরিক এবং মহাকাশ গবেষণার মতো অধিক সুরক্ষা প্রয়োজনীয় স্থানে অপটিক্যাল ফাইবার অত্যন্ত কার্যকর। এটি ডেটা সুরক্ষার পাশাপাশি নির্ভুল যোগাযোগ নিশ্চিত করে।
  • স্মার্ট সিটি: আধুনিক স্মার্ট সিটির জন্য অপটিক্যাল ফাইবার অপরিহার্য। এটি স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, নিরাপত্তা ক্যামেরা এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।

বর্তমানে অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তি যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর উচ্চ গতির ডেটা স্থানান্তর, স্থায়িত্ব এবং নির্ভরযোগ্যতা অন্যান্য প্রযুক্তির তুলনায় অনেক এগিয়ে। অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তি ভবিষ্যতের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর কার্যকারিতা এবং বহুমুখী ব্যবহারের কারণে এটি আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ আলোর গতির চেয়ে দ্রুত কিছু কি সম্ভব? বিজ্ঞান কী বলে?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো