মানুষ শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত উন্নতি করছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল এবং ইউকে অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি (UKAEA) বিজ্ঞানীরা এমন এক ব্যাটারি উদ্ভাবন করেছেন, যা হাজার বছর ধরে কাজ করতে পারে। তারা কার্বন-১৪ নামে একটি রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার-ডায়মন্ড ব্যাটারি তৈরি করেছেন।
এই ব্যাটারি কার্বন-১৪ এর রেডিওঅ্যাকটিভ ডিকেয়কে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। কার্বন-১৪ একটি রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান, যা ডায়মন্ডের ভেতর আবদ্ধ থাকে। ডায়মন্ড পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থগুলোর একটি, যা রেডিয়েশনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কার্বন-১৪ থেকে নির্গত রেডিয়েশন ডায়মন্ডের মাধ্যমে পুরোপুরি শোষিত হয়, তাই এটি ব্যবহার করা নিরাপদ।
আরও পড়ুনঃ মঙ্গল গ্রহের জন্য ব্যাটারি তৈরি করেছে চীন
ডায়মন্ড ব্যাটারির কাজ অনেকটা সৌর প্যানেলের মতো। সৌর প্যানেল যেখানে আলো থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে, সেখানে এই ব্যাটারি রেডিওঅ্যাকটিভ ডিকেয় থেকে উৎপন্ন ইলেকট্রন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে কোনো মুভিং পার্টস না থাকায় এটি রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই দীর্ঘদিন কাজ করতে সক্ষম। এই ব্যাটারিতে ব্যবহৃত কার্বন-১৪ সাধারণত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রাফাইট ব্লক থেকে সংগ্রহ করা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় ব্যবহৃত গ্রাফাইট ব্লকের পৃষ্ঠে কার্বন-১৪ জমা হয়। এর অর্ধায়ু ৫,৭০০ বছর, অর্থাৎ এটি ৫০% শক্তি হারাতে এত বছর সময় নেবে। ফলে এই ব্যাটারি অনেক দিন পর্যন্ত শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম।
একটি নিউক্লিয়ার-ডায়মন্ড ব্যাটারি দিনে প্রায় ১৫ জুল শক্তি সরবরাহ করতে পারে। তুলনায় একটি সাধারণ AA ব্যাটারি দিনে বেশি শক্তি সরবরাহ করে, কিন্তু তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে, নিউক্লিয়ার ব্যাটারি কয়েক হাজার বছর ধরে কাজ করতে পারে। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। মহাকাশ গবেষণায় এটি স্যাটেলাইট ও মহাকাশযানে ব্যবহৃত হতে পারে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি পেসমেকার, হিয়ারিং এইড এবং অন্যান্য ইমপ্ল্যান্টে ব্যবহার করা যাবে, যা দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করবে। দুর্গম ও বিপজ্জনক এলাকায় যেমন সমুদ্রতলের তেল এবং গ্যাস খননের যন্ত্রেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরণ এর ঝুঁকি আর থাকবেনা
এই ব্যাটারির উৎপাদনে কার্বন-১৪ ব্যবহার করা হয়, যা মূলত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য। যুক্তরাজ্যে প্রায় ৯৫,০০০ টন গ্রাফাইট ব্লক মজুদ রয়েছে, যা এই ব্যাটারির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। গ্রাফাইট ব্লকের পৃষ্ঠ থেকে কার্বন-১৪ সংগ্রহ করা হয় এবং এটি ডায়মন্ড কাঠামোতে রূপান্তর করতে প্লাজমা ডিপোজিশন রিগ ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও সাহায্য করে।
নিউক্লিয়ার-ডায়মন্ড ব্যাটারির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি কোনো মুভিং পার্টস ছাড়াই কাজ করে, ফলে এটি রক্ষণাবেক্ষণ-মুক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী। এর রেডিয়েশন সুরক্ষা ডায়মন্ডের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ায় এটি ব্যবহারে কোনো ঝুঁকি থাকে না। এমনকি এর ব্যবহার শেষে ব্যাটারিটি পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব।
ডায়মন্ড ব্যাটারি শক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। এটি শুধুমাত্র শক্তির উৎস নয়, বরং একটি টেকসই এবং নিরাপদ সমাধান। উদাহরণস্বরূপ, এটি এমন জায়গায় ব্যবহার করা যাবে যেখানে সাধারণ ব্যাটারির ব্যবহার সম্ভব নয়। মহাকাশ গবেষণায়, যেমন স্যাটেলাইট এবং দূরবর্তী স্থানে ব্যবহারের জন্য এটি আদর্শ। চিকিৎসাক্ষেত্রে, যেমন পেসমেকার বা হিয়ারিং এইডে এই ব্যাটারি দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারে। এছাড়া দুর্গম পরিবেশে, যেমন সমুদ্রতলে তেল এবং গ্যাস খননের যন্ত্রেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে।
কার্বন-১৪ এর রেডিওঅ্যাকটিভ ডিকেয় এবং ডায়মন্ডের শক্তি শোষণ ক্ষমতা একত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকরী ব্যাটারি তৈরিতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এই উদ্ভাবন শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরও বিস্তৃত হতে পারে।
ওজনহীন ব্যাটারি প্রযুক্তি উদ্ভাবন যা ইলেকট্রিক যানবাহনের রেঞ্জ বাড়াবে ৭০% পর্যন্ত