নিম্ন-নির্গমন হাইড্রোজেন উৎপাদন করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ইলেক্ট্রোলাইসিস। এই পদ্ধতিতে বিদ্যুতের মাধ্যমে পানিকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে বিভক্ত করা হয়। এটি একটি পরিচ্ছন্ন এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি যা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি দ্বারা চালানো যেতে পারে। এছাড়াও, তাপ-রাসায়নিক পানি বিভাজন নামে পরিচিত একটি পদ্ধতিও রয়েছে, যা কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তি বা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য তাপ ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে সক্ষম। হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের উৎস ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি এবং জীববস্তু (বায়োমাস)। তবে, হাইড্রোজেন উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাব এবং শক্তির কার্যকারিতা নির্ভর করে এটি কীভাবে উৎপাদিত হয় তার উপর। উদাহরণস্বরূপ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হাইড্রোজেন কার্বন নিঃসরণ বাড়াতে পারে, যেখানে ইলেক্ট্রোলাইসিসের মাধ্যমে উৎপাদিত হাইড্রোজেন সম্পূর্ণরূপে কার্বন-মুক্ত। সৌরশক্তি চালিত পদ্ধতিগুলো সহজে এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য একটি উদীয়মান বিকল্প হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াগুলোতে আলোক শক্তি একটি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। সৌরশক্তির মাধ্যমে শিল্প-স্কেলের হাইড্রোজেন উৎপাদনের সম্ভাবনা খুবই আশাব্যঞ্জক।
আরও পড়ুনঃ “নেগেটিভ সময়” এটি কি সত্যি আছে? নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে কিছু আশ্চর্য তথ্য
সম্প্রতি, এই বিষয়ে নতুন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে যা টেক্সাসের বেইলর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি এবং বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক পল ম্যাগার্ডের নেতৃত্বে পূর্ববর্তী কাজের উপর ভিত্তি করে তৈরি। গবেষণাটি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (ACS) জার্নাল অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি সি-তে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের অবদান রয়েছে। এর মধ্যে রসায়নের অধ্যাপক গ্রেগ মেথার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন, যিনি মেটাল ক্লাস্টার এবং অক্সাইড পৃষ্ঠের উপর তাদের ফটো-ক্যাটালিটিক কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় জার্মানির ইউনিভার্সিটি মুনস্টারও অংশগ্রহণ করেছে।
নিম্ন-নির্গমন হাইড্রোজেন উৎপাদনের প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ইলেক্ট্রোলাইসিস একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এতে পানি থেকে হাইড্রোজেন আলাদা করার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। তবে, এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ যদি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি থেকে আসে, তবে এটি পরিবেশের জন্য আরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, এবং জলবিদ্যুৎ ইলেক্ট্রোলাইসিসের জন্য উপযুক্ত শক্তির উৎস। উদাহরণস্বরূপ, সৌরবিদ্যুৎ দ্বারা চালিত ইলেক্ট্রোলাইসিস ব্যবহৃত হলে, এটি সম্পূর্ণরূপে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পদ্ধতিতে পরিণত হয়। তাপ-রাসায়নিক পদ্ধতিগুলো আরও একটি সম্ভাব্য বিকল্প। এতে কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তি ব্যবহার করে পানির তাপীয় বিভাজন করা হয়। এই পদ্ধতিতে উচ্চ তাপমাত্রায় পানি বিভক্ত হয়ে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে রূপান্তরিত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য তাপও এই প্রক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, যা টেকসই শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বায়োমাস থেকেও হাইড্রোজেন উৎপাদন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে বাষ্পের পুনর্গঠন পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন তৈরি করা হয়। তবে, এই পদ্ধতিগুলো সাধারণত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই কারণে, কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ (CCS) প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই নিঃসরণ কমানো সম্ভব। জীববস্তু বা বায়োমাস থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদন আরও একটি টেকসই বিকল্প। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি এবং বনজ শিল্পের বর্জ্য ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা যায়। এটি পুনর্ব্যবহারের একটি চমৎকার উপায় এবং পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়ক।
সৌর চালিত প্রক্রিয়াগুলো হাইড্রোজেন উৎপাদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। সৌরশক্তি-চালিত ফটো-ক্যাটালাইসিস পদ্ধতিতে সূর্যালোক সরাসরি পানির উপর প্রভাব ফেলে এবং হাইড্রোজেন আলাদা করে। এই প্রক্রিয়ার জন্য উন্নত ফটো-ক্যাটালিস্টের প্রয়োজন, যা আলোর শোষণ এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া বাড়ায়। গবেষকরা বর্তমানে ফটো-ক্যাটালিস্টের কার্যকারিতা বাড়াতে কাজ করছেন, যাতে এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়।
ফটোইলেক্ট্রোকেমিক্যাল (PEC) কোষগুলিও সৌরশক্তি থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এতে সৌরশক্তি ব্যবহার করে পানি বিভাজন করা হয়। PEC কোষগুলোতে অর্ধপরিবাহী উপকরণ ব্যবহৃত হয়, যা আলো শোষণ করে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই বিদ্যুৎ পানি বিভাজনের জন্য ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে এই পদ্ধতির সফলতা দেখা গেলেও, এর বাণিজ্যিকীকরণে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি নতুন ফটো-ক্যাটালিস্ট এবং পদ্ধতির উন্নয়নে সাহায্য করছে। এতে ধাতব ক্লাস্টার এবং অক্সাইড পৃষ্ঠের ফটো-ক্যাটালিটিক কার্যক্রম নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল শিল্প-স্কেলের হাইড্রোজেন উৎপাদনের সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। নিম্ন-নির্গমন হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য ইলেক্ট্রোলাইসিস, তাপ-রাসায়নিক পদ্ধতি, এবং সৌরশক্তি-চালিত প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সৌরশক্তি চালিত প্রক্রিয়াগুলো সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন এবং টেকসই। গবেষণার অগ্রগতি এই প্রযুক্তিগুলোর কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলছে, যা ভবিষ্যতে একটি পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎস হিসাবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ মারাত্মক ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার অন্যতম বড় উৎস গাড়ির টায়ার