নতুন ধরণের প্লাস্টিক উপাদান যা একইসঙ্গে প্রসারণযোগ্য, নমনীয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং খরচ-সাশ্রয়ী

প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি নতুন ধরণের প্লাস্টিক উপাদান উদ্ভাবন করেছেন যা একইসঙ্গে প্রসারণযোগ্য, নমনীয়, অন্যদিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং খরচ-সাশ্রয়ী। এই উদ্ভাবনের পেছনে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার একটি দৃঢ় পটভূমি রয়েছে। প্রথমে, গবেষকরা বিভিন্ন ধরনের পলিমারের ভৌত এবং রাসায়নিক গুণাবলী পরীক্ষা করেন, বিশেষ করে সেগুলোর ন্যানোস্কেল কাঠামো কিভাবে কাজ করে তা বিশ্লেষণ করেন। গবেষণার সময় তারা লক্ষ্য করেন যে ব্লক কপোলিমার নামক একটি বিশেষ পলিমার তাপমাত্রার পরিবর্তনে কাঠামোগতভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং এই বৈশিষ্ট্যটি প্রিন্টিং প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করা যায়। এই গবেষণার ভিত্তিতে, তারা একটি বিশেষ ৩ডি প্রিন্টিং পদ্ধতি তৈরি করেন যা ন্যানোস্কেল স্তরে উপাদানের কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই উপাদানের উদ্ভাবন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এই গবেষণাটি সম্প্রতি “অ্যাডভান্সড ফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালস” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার মূল দিকটি ছিল তাপীয় প্লাস্টিক ইলাস্টোমার নামক এক ধরনের পলিমার ব্যবহার করে একাধিক গুণাবলী সমন্বিত উপাদান তৈরি করা।

আরও পড়ুনঃ আলোর মাধ্যমে জটিল অণু নিয়ন্ত্রণের কৌশল উদ্ধাবন

গবেষণার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই উপাদানের গঠন। এটি ব্লক কপোলিমার নামক বিশেষ পলিমার দিয়ে তৈরি, যা গঠনগতভাবে দুটি ভিন্ন প্রকারের পলিমারের সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই ব্লক কপোলিমারগুলোর অভ্যন্তরে কঠিন সিলিন্ড্রিকাল কাঠামো থাকে, যা মাত্র ৫-৭ ন্যানোমিটার পুরু। তুলনামূলকভাবে, মানুষের চুলের ব্যাস প্রায় ৯০,০০০ ন্যানোমিটার। এই কঠিন সিলিন্ডারগুলি একটি নমনীয় পলিমার ম্যাট্রিক্সের মধ্যে থাকে। ৩ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ন্যানো-কাঠামো সমূহকে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে উপাদানটি একদিকে শক্ত থাকে এবং অন্যদিকে প্রসারণযোগ্য এবং নমনীয় হয়।

এই প্রযুক্তির মূল উদ্ভাবক দলের সদস্যরা হলেন প্রফেসর এমিলি ডেভিডসন এবং অ্যালিস ফার্গারসন। ডেভিডসন জানান, ৩ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির মাধ্যমে উপাদানটির প্রসারণযোগ্যতা এবং শক্তির গুণাবলী নির্ধারণ করা সম্ভব। এই উপাদানের বহুমুখিতা নকশাকারদের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন সফট রোবটিক্স, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হালকা হেলমেট এবং উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন জুতার সোল তৈরিতে সহায়তা করবে।

উপাদানের একান্ত কাঠামো গঠনে তাপীয় অ্যানিলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় উপাদানটি উত্তপ্ত এবং ঠাণ্ডা করা হয়, যা তার অভ্যন্তরীণ কাঠামোর সঠিক বিন্যাস নিশ্চিত করে। অ্যালিস ফার্গারসনের মতে, তাপীয় অ্যানিলিং প্রক্রিয়া উপাদানের শক্তি বাড়ায় এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত করে। এটি এমনকি উপাদানটিকে নিজে থেকে পুনরায় মেরামত করতেও সক্ষম করে। একটি নমনীয় প্লাস্টিকের টুকরো কেটে ফেলার পর তা আবার একত্রিত করা যায় এবং অ্যানিলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা যায়। এই পদ্ধতিতে মেরামতকৃত উপাদানটি মূল উপাদানের মতোই শক্তিশালী এবং কার্যকরী থাকে।

গবেষণার অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল উপাদানটির উৎপাদন খরচ কম রাখা এবং শিল্পখাতে এটি সহজলভ্য করা। প্রচলিত প্রযুক্তিতে লিকুইড ক্রিস্টাল ইলাস্টোমার ব্যবহার করে একই ধরনের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এই উপাদানের প্রতি গ্রাম খরচ প্রায় ২.৫০ ডলার, যেখানে প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত তাপীয় প্লাস্টিক ইলাস্টোমারের খরচ মাত্র এক সেন্ট প্রতি গ্রাম।

অতিরিক্ত কার্যক্ষমতার জন্য এই উপাদানে ফাংশনাল অ্যাডিটিভ যোগ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একটি বিশেষ অর্গানিক অণু যোগ করা হয়েছে, যা অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে লাল আলো নির্গত করে। এছাড়াও জটিল এবং বহুস্তর বিশিষ্ট কাঠামো তৈরি করার ক্ষমতাও এই ৩ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষকরা একটি ছোট প্লাস্টিকের ফুলদানি এবং প্রিন্সটন শব্দটি তৈরি করেছেন, যা বিভিন্ন তীক্ষ্ণ বাঁক ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

গবেষণার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই উপাদান পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং টেকসই। এর ব্যবহার পরিবেশবান্ধব এবং এটি প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সহায়ক হতে পারে। তাপীয় অ্যানিলিংয়ের মাধ্যমে পুরনো উপাদান নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একটি ফাটা নমনীয় প্লাস্টিকের টুকরো তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সহজেই পুনরায় সংযুক্ত করা যায় এবং তা আগের মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই উদ্ভাবনের পরবর্তী ধাপ হলো আরও উন্নত এবং কার্যকরী ৩ডি প্রিন্টেবল স্থাপত্যের বিকাশ, যা পরিধানযোগ্য ইলেকট্রনিক্স এবং চিকিৎসা ডিভাইসের মতো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। গবেষকরা আশা করছেন, এই প্রযুক্তির সাহায্যে ভবিষ্যতে আরও জটিল এবং ব্যবহারিক নকশা তৈরি করা সম্ভব হবে।

প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীদের এই উদ্ভাবন নানাবিধ সমস্যার কার্যকর সমাধান প্রদান করতে পারে। এর সহজলভ্যতা, বহুমুখিতা, এবং খরচ সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্য এটিকে বর্তমান প্রযুক্তির চেয়ে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটি কেবল নতুন পণ্য তৈরিতেই নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও একটি টেকসই সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই উদ্ভাবনটি প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে এবং এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসীম সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে পারে।

সৌরশক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে হাইড্রোজেন উৎপাদন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো