মেটা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানি। সম্প্রতি মেটা তাদের তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্ট-চেকিং সিস্টেম বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে মেটা নিয়ে প্রচুর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এরি প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং থ্রেডস মেটার প্ল্যাটফর্ম থেকে অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা নিয়ে গুগল সার্চে ট্রেন্ড করছে। মার্ক জুকারবার্গ, মেটার সিইও, জানিয়েছেন যে তারা বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক বিষয়বস্তু প্রদর্শনের সীমা শিথিল করবে। এই সিদ্ধান্তটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে সামাজিক মাধ্যমে গুজব, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভ্রান্ত তথ্য আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মেটা তাদের নিজস্ব এআই চালিত প্রোফাইলগুলোকে বন্ধ করে দিচ্ছে
মেটার সিদ্ধান্ত অনেকের মতে, আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধ এড়ানোর একটি প্রচেষ্টা। সমালোচকরা মনে করেন, মেটার নতুন নীতিগুলি অনলাইনে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং সহিংসতাকে উৎসাহিত করতে পারে। এই কারণে ব্যবহারকারীরা দ্রুত মেটার প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করার পথ গুগলে সার্চ করছেন। গুগল ট্রেন্ডস অনুযায়ী, “how to permanently delete Facebook” (কীভাবে ফেসবুক চিরতরে মুছবেন) এর মতো কিওয়ার্ডগুলির প্রচুর পরিমাণে ট্রেন্ডে আছে। এছাড়াও, “how to delete all photos Facebook,” “alternative to Facebook,” “how to quit Facebook,” “how to delete Threads account,” এবং “how to delete Instagram account without logging in” এর মতো কিওয়ার্ডগুলিও ট্রেন্ড করছে যা ৫,০০০% এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিস্ফোরক বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে ব্যবহারকারীরা মেটার নতুন নীতিগুলি থেকে দূরে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছেন।
মেটার ফ্যাক্ট-চেকিং এবং বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ নীতিগুলি মূলত প্ল্যাটফর্মে ভ্রান্ত তথ্য এবং সহিংস বক্তব্যের বিস্তার রোধ করার জন্য চালু করা হয়েছিল। তবে, এই নীতিগুলির ঘাটতি অতীতে বড় বড় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন ক্যাপিটলে সংঘটিত দাঙ্গা মেটার প্ল্যাটফর্মে সহিংসতার আহ্বানের কারণে প্রভাবিত হয়েছিল। ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ নথি থেকে জানা যায়, কোম্পানি “স্টপ দ্য স্টিল” আন্দোলন দমনে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি।
এমনকি মেটার প্ল্যাটফর্ম মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা প্ররোচিত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। মেটা নিজেই স্বীকার করেছে যে তাদের প্ল্যাটফর্ম বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২১ সালে জুকারবার্গ বলেছিলেন যে মেটার ব্যবহারকারীরা রাজনীতি এবং লড়াইকে তাদের সামাজিক মাধ্যমের অভিজ্ঞতায় জায়গা দিতে চান না। এই চিন্তার ভিত্তিতেই তারা রাজনৈতিক বিষয়বস্তু প্রদর্শনে সীমা আরোপ করেছিল। কিন্তু এখন তারা আবার সেই সীমা সরিয়ে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
মার্ক জুকারবার্গ বলছেন, মেটার নতুন নীতিগুলি প্ল্যাটফর্মে মুক্ত মত প্রকাশ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্ট-চেকারদের বদলে একটি কমিউনিটি নোটস সিস্টেম চালু করা হবে, যেখানে ব্যবহারকারীরা পোস্টের প্রসঙ্গ যোগ করার সুযোগ পাবেন। এই সিস্টেমটি টুইটারের (বর্তমান যার নাম এক্স) মতো।
মেটার এই পরিবর্তনের ফলে শুধুমাত্র ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম নয়, বরং সম্পূর্ণ প্ল্যাটফর্মের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গুগল অনুসন্ধানে দেখা গেছে, “Facebook alternatives” (ফেসবুকের বিকল্প) এর মতো অনুসন্ধানগুলিও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি ব্লুস্কাই এবং মাস্টোডনের মতো বিকেন্দ্রীকৃত সামাজিক মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। মাস্টোডনের সিইও ইউজেন রশকো মেটার নতুন নীতিগুলোর সমালোচনা করে বলেছেন যে এটি নৈতিক বিবেকসম্পন্ন যে কারও জন্য উদ্বেগজনক।
তিনি আরও জানান, থ্রেডসের মাধ্যমে মাস্টোডনে পোস্ট করা ব্যবহারকারীদের ওপর কড়া নজর রাখা হবে যাতে তাদের বক্তব্য মাস্টোডনের নীতি লঙ্ঘন না করে। মাস্টোডন এবং ব্লুস্কাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলির প্রতি ব্যবহারকারীদের ঝোঁক বেড়ে যাওয়া থেকে বোঝা যায় যে মেটার পরিবর্তনের ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আরও নির্ভরযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্মের সন্ধান করছে।
মেটার নীতিগত পরিবর্তন এবং এর পরিণতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচিত হচ্ছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং নীতি নির্ধারকরা বলছেন, বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ এবং সত্য যাচাই ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার ফলে অনলাইনে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভ্রান্ত তথ্যের বিস্তার বাড়তে পারে, যা বাস্তব জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা তাদের অনলাইন নিরাপত্তা এবং বিশ্বস্ততার বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন। ফলে মেটার নতুন নীতিগুলি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী জনপ্রিয়তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।