টাইম ট্র্যাভেল ”গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স” এর রহস্য উদঘাটনে নতুন তথ্য দিলো এক পদার্থবিদ

টাইম ট্র্যাভেলের ধারণাটি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কল্পনা এবং বিজ্ঞান-কল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে আছে। তবে, একে বাস্তবে সম্ভব করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে একটি হলো তথাকথিত “গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।” এই প্যারাডক্সটি একটি মৌলিক লজিক্যাল সমস্যা তৈরি করে, যেখানে প্রশ্ন করা হয়, কেউ যদি অতীতে ফিরে গিয়ে তার দাদাকে সন্তান জন্মদানে বাধা দেয়, তবে তার নিজের অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভব হবে? এই জটিলতার কারণে, সময় ভ্রমণকে প্রায়ই অসম্ভব বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি একটি গবেষণা এই প্যারাডক্সটি সমাধান করার দাবি করেছে।

শারীরিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং থার্মোডাইনামিক্সের সমন্বয়ে এই নতুন গবেষণা দেখিয়েছে যে টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব হতে পারে, এবং এটি লজিক্যাল প্যারাডক্স তৈরি না করেও কার্যকর হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ টাইম মেশিন তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব ? কি কেন ও কিভাবে

আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় সময় একটি সরলরেখার মতো, যা শুধুমাত্র অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, যা ১৯১৫ সালে প্রণীত হয়, দেখায় যে সময় এবং স্থান একটি ত্রিমাত্রিক কাঠামো গঠন করে, যাকে বলা হয় স্পেস-টাইম। এই তত্ত্ব অনুসারে, স্পেস-টাইমের কাঠামো ভাঁজ হতে পারে, যা সময়কে একটি লুপের মতো বাঁকিয়ে দিতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভস (CTCs)।

গবেষক লরেঞ্জো গাভাসিনো, ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পদার্থবিজ্ঞানী, তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে একটি ঘূর্ণায়মান মহাবিশ্বে এই ধরনের ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভস তৈরি হতে পারে। যখন বড় ভরবাহী বস্তু, যেমন ব্ল্যাক হোল, ঘূর্ণায়মান থাকে, তখন তারা স্পেস-টাইমকে এতটা বিকৃত করতে পারে যে সময় একটি লুপে পরিণত হয়। যদিও আমাদের মহাবিশ্ব সমগ্রভাবে এই ধরনের ঘূর্ণায়মান বলে মনে হয় না, তবুও স্থানীয়ভাবে ব্ল্যাক হোলের মতো পরিবেশে CTCs-এর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

টাইম ট্র্যাভেলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্যারাডক্স। “গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স” ছাড়াও আরও অনেক ধরনের প্যারাডক্স রয়েছে। এগুলো সাধারণত ধরে নেয় যে থার্মোডাইনামিক্সের আইনগুলো টাইম লুপের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে। থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় আইন বলে, একটি সিস্টেমের এন্ট্রপি, অর্থাৎ বিশৃঙ্খলার মাত্রা, সময়ের সাথে বাড়ে। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করে, যেমন স্মৃতি তৈরি হওয়া বা শরীরের বয়স বাড়া।

কিন্তু গাভাসিনোর গবেষণা বলছে, ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভসে এন্ট্রপির আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই লুপে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন তৈরি হয়, যা এন্ট্রপিকে মুছে দিতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহ উল্টে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন সময় ভ্রমণকারী যদি এই ধরনের লুপে প্রবেশ করে, তার স্মৃতি মুছে যেতে পারে এবং বয়স কমে যেতে পারে।

আইনস্টাইনের পাজল প্রিন্সিপল বদলে দিতে পারে আপনার জীবন

গাভাসিনো দাবি করেন যে এই প্রক্রিয়াগুলো “গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স”-এর মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে। যদি কেউ লুপের মধ্যে গিয়ে তার দাদাকে হত্যা করার চেষ্টা করে, তবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন সেই ঘটনাকে অস্থায়ী করে তুলতে পারে। এর ফলে সময়ের লজিক্যাল ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে। এই পদ্ধতিতে গাভাসিনো “সেল্ফ-কনসিসটেন্সি প্রিন্সিপল”-এর একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছেন, যা বলে যে টাইম লুপের মধ্যে সমস্ত ঘটনা একটি লজিক্যাল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প তৈরি করে।

গাভাসিনো তার গবেষণায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রচলিত কাঠামো ব্যবহার করেছেন। তিনি কোনও অতিরিক্ত অনুমান বা বিতর্কিত তত্ত্বের উপর নির্ভর করেননি। এটি তার কাজকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

তবে, বাস্তবে ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভসের অস্তিত্ব নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ১৯৯২ সালে “ক্রোনোলজি প্রোটেকশন কনজেকচার” তত্ত্বটি প্রস্তাব করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের আইনগুলো টাইম লুপ তৈরিকে বাধা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি টাইম লুপ তৈরি হওয়ার আগেই স্পেস-টাইম ভেঙে পড়তে পারে।

তবুও, গাভাসিনোর গবেষণা টাইম ট্র্যাভেলের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে একটি নতুন দিশা দেখিয়েছে। যদিও এটি বাস্তবে সম্ভব কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়, তবে এই তত্ত্বগুলো আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং এন্ট্রপির আচরণ সম্পর্কে গভীরতর বোঝার পথ খুলে দিচ্ছে।

এই গবেষণার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং থার্মোডাইনামিক্সের মধ্যে সংযোগ নিয়ে কাজ করেছে। কোয়ান্টাম স্তরে এন্ট্রপির আচরণ এবং এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা আমাদের মহাবিশ্বের মৌলিক আইন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্ল্যাক হোলের কাছে এন্ট্রপির বিবর্তন অধ্যয়ন করা আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম ও ধ্বংসের প্রক্রিয়া বোঝার জন্য সহায়ক হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, গাভাসিনোর গবেষণা টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারায় একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যদিও এটি এখনও বাস্তবায়নের পর্যায়ে নেই, তবে এর তাত্ত্বিক গুরুত্ব অসীম। টাইম লুপের প্রভাব, এন্ট্রপির বিপরীতগতি, এবং কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ভূমিকা নিয়ে আরও গবেষণা ভবিষ্যতে টাইম ট্র্যাভেলকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।

১১তম ডাইমেনশন কি? ডাইমেনশনের মাধ্যমে কিভাবে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো