আলঝেইমার রোগ নিরাময় করবে ডায়াবেটিসের ওষুধ

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, ডায়াবেটিসের জন্য ব্যবহৃত জনপ্রিয় ওষুধ সেমাগ্লুটাইড (বাজারে যা ওজেম্পিক ও ওয়েগোভি নামে পরিচিত) টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ স্কুল অব মেডিসিন-এর গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই ওষুধটি ব্যবহারকারী রোগীরা অন্যান্য সাতটি ডায়াবেটিসের ওষুধ ব্যবহারকারী রোগীদের তুলনায় আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। এই আবিষ্কার টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বড় ধরনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, যেখানে সঠিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

আলঝেইমার রোগ কি ?

আলঝেইমার রোগ হলো একটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ, যা মূলত মস্তিষ্কের কোষের ক্ষয় এবং মৃত্যু ঘটায়। এর ফলে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি এবং দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা হ্রাস পায়। এটি সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা গেলেও কিছু ক্ষেত্রে কম বয়সেও এটি আক্রমণ করতে পারে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলির মধ্যে যোগাযোগ কমে যাওয়ার মাধ্যমে এই রোগ শুরু হয়, যা সময়ের সাথে আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। প্রথমে ছোটখাটো স্মৃতিভ্রংশ দেখা যায়, যেমন সাম্প্রতিক ঘটনা বা পরিচিত মুখ ভুলে যাওয়া। ধীরে ধীরে এটি আরও বড় সমস্যায় রূপান্তরিত হয়, যেখানে রোগী তাদের পরিচিত পরিবেশ, এমনকি প্রিয়জনদেরও ভুলে যেতে শুরু করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই দিশাহীন হয়ে পড়েন এবং মানসিক অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। এখন পর্যন্ত আলঝেইমার রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা নিরাময় নেই, তবে কিছু ওষুধের মাধ্যমে এর লক্ষণগুলোকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক কার্যকলাপ ধরে রাখার মাধ্যমে রোগের প্রভাব কিছুটা বিলম্বিত করা সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়

গবেষণার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং গবেষণা পদ্ধতি

আলঝেইমার রোগ
ছবিঃ এবিসিটেকওয়ার্ল্ড

আলঝেইমার রোগ এমন একটি মস্তিষ্কজনিত রোগ যা ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। আমেরিকায় ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এই রোগ প্রতি বছর ব্রেস্ট এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার মিলিয়ে যত মৃত্যুর কারণ হয়, তার চেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগের ভয়াবহতা বুঝে কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর সেমাগ্লুটাইড ওষুধের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন।

গবেষণাটি আলঝেইমারস অ্যান্ড ডিমেনশিয়া: দ্য জার্নাল অব দ্য আলঝেইমারস অ্যাসোসিয়েশন-এ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যারা সেমাগ্লুটাইড ব্যবহার করছেন, তাদের আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এই গবেষণার জন্য প্রায় ১০ লক্ষ মার্কিন রোগীর তিন বছরের ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করে এটি র‌্যান্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো করে পরিচালনা করা হয়েছে।

গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বায়োমেডিক্যাল ইনফরমেটিক্সের অধ্যাপক রং জু, যিনি কেন্দ্রীয়ভাবে এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। তার দল দেখিয়েছেন যে সেমাগ্লুটাইড ব্যবহারকারী রোগীদের আলঝেইমার ঝুঁকি কম থাকলেও অন্য কোন ডায়াবেটিসের ওষুধে তেমন প্রভাব দেখা যায়নি। এমনকি একই গ্রুপের GLP-1R লক্ষ্য করে তৈরি ওষুধেও এরকম প্রভাব দেখা যায়নি।

সেমাগ্লুটাইড কীভাবে কাজ করে?

সেমাগ্লুটাইড একটি বিশেষ ধরনের ওষুধ যা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। এটি GLP-1R (গ্লুকাগন-লাইক পেপটাইড-১ রিসেপ্টর) নামক এক ধরনের রিসেপ্টরে কাজ করে। এই রিসেপ্টরের মাধ্যমে রোগীর ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। ওজেম্পিক ও ওয়েগোভির মতো জনপ্রিয় ওষুধগুলোতে এই সেমাগ্লুটাইড সক্রিয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা শুধু ডায়াবেটিস নয় বরং ওজন কমাতেও সহায়ক।

গবেষণার ফলাফল এবং এর প্রভাব

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, সেমাগ্লুটাইড ব্যবহারে আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়, যা দীর্ঘমেয়াদীভাবে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগীরা সাধারণত আলঝেইমার রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। সেমাগ্লুটাইড এই ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বড় আবিষ্কার।

সেমাগ্লুটাইড শুধু যে আলঝেইমার ঝুঁকি হ্রাস করে তা নয়, এটি মস্তিষ্কে নিউরোডিজেনারেশন এবং নিউরোইনফ্লামেশন প্রতিরোধেও সহায়ক বলে মনে করা হয়। যদিও এটি সরাসরি আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত নয়, তবে এটি রোগের প্রাথমিক স্তরে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে।

প্রতি বছর প্রায় ১২০,০০০ আমেরিকান আলঝেইমার রোগে মারা যায় এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সপ্তম প্রধান মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য হয়। এই গবেষণার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে, ডায়াবেটিস রোগীদের আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমাতে সেমাগ্লুটাইড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আরও পড়ুনঃ কুরআন ও বিজ্ঞান : সৃষ্টির রহস্যের মিলন

ভবিষ্যত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এবং সীমাবদ্ধতা

গবেষণার প্রধান গবেষক রং জু বলেছেন, “যদিও আমাদের গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে সেমাগ্লুটাইড আলঝেইমার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু এটি প্রমাণ করার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।” গবেষণাটি মূলত পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা হওয়ায় এতে সরাসরি কারণ-প্রভাব সম্পর্ক নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে র‌্যান্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে এটি আরও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

এই গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, এটি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগীদের ওপর পরিচালিত এবং এর ডেটা সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। গবেষণার ফলাফল যেহেতু প্রাথমিক স্তরের, তাই ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ এবং বৈচিত্র্যময় ডেটার ওপর গবেষণা করে এটি নিশ্চিত করতে হবে।

ভবিষ্যতে সেমাগ্লুটাইডের ব্যবহার

এই গবেষণার ফলাফল আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে সেমাগ্লুটাইডের সম্ভাবনাকে জোরদার করে। বর্তমানে, এই ওষুধটি শুধুমাত্র ডায়াবেটিস এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এই নতুন আবিষ্কার ভবিষ্যতে এটি মস্তিষ্কজনিত রোগ প্রতিরোধে ব্যবহারের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে, ভবিষ্যতে সেমাগ্লুটাইডের মতো অন্যান্য ওষুধগুলিও আলঝেইমার এবং অন্যান্য মস্তিষ্কজনিত রোগ প্রতিরোধে ব্যবহার করা যেতে পারে।

উপসংহার

আলঝেইমার রোগ একটি জটিল এবং নিরাময়হীন নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ, যা মস্তিষ্কের কোষের ধ্বংসের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্মৃতি ও মানসিক ক্ষমতা হ্রাস করে। এর কোনো স্থায়ী চিকিৎসা না থাকায়, আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজগুলো করতেও অসুবিধার সম্মুখীন হন। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি রোগের লক্ষণগুলো কিছুটা কমাতে সহায়ক হলেও, এটি পুরোপুরি নিরাময় করতে পারে না। তাই, আলঝেইমার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো