পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে একটি ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির গ্রহাণু যেটি পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা পূর্বে হিসাবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পয়েছে। তবে এখনো এটিকে প্রতিহত করার জন্য কোনো মহাকাশযান নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
২০২৪ সালের বড়দিনে ৯০ মিটার প্রশস্ত একটি গ্রহাণু পৃথিবীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, যা দুই দিন পর চিলির একটি টেলিস্কোপ দ্বারা শনাক্ত করা হয়। এই গ্রহাণুটির নাম ২০২৪ YR4। বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর এটি পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা ২.৩ শতাংশ, যা পূর্বের হিসাবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি।
৫০ মিটারের বেশি আকারের কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা ১ শতাংশের বেশি হলে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বিষয়টি পর্যালোচনা করে। বর্তমানে ২০২৪ YR4 নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ESA) গ্রহাণু-ঝুঁকি তালিকার শীর্ষে রয়েছে। নাসার হিসাব অনুযায়ী, গ্রহাণুটি প্রায় ২,৫০,০০০ টন ওজনের এবং এটি যদি পৃথিবীতে আঘাত হানে, তাহলে প্রায় ২.২ মিলিয়ন টন TNT বিস্ফোরণের সমান শক্তি উৎপন্ন হবে। এটি হিরোশিমার উপর নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার শক্তির তুলনায় ১৫০ গুণ বেশি।
কোন কোন অঞ্চল ঝুঁকিতে আছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানে, তাহলে যুক্তরাজ্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে পশ্চিম আফ্রিকার শহর যেমন লাগোস ও আকরা, ভারতের মুম্বাই এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো যেমন ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়া ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রহাণুটির আঘাতে একটি পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং স্থানীয়ভাবে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। ১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার একটি বনভূমিতে একই আকারের একটি গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল, যার ফলে প্রায় এক হাজার বর্গমাইল এলাকা ধ্বংস হয়েছিল।
বর্তমান পর্যবেক্ষণ
গ্রহাণুটি মে মাসের প্রথম দিকে পৃথিবীর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবে। এই সময়ের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর গতিপথ ও আঘাতের সম্ভাবনা আরও বিশদভাবে বিশ্লেষণ করবেন। এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে, গ্রহাণুটির আঘাতের সম্ভাবনা বেড়েছে এবং এটি আরও বাড়তে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিষয়ে আরো বিশদভাবে বিশ্লেষণ হলে নিখুঁত তথ্য প্রদান করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় অব গ্লাসগোর পরিসংখ্যান ও তথ্য বিশ্লেষণের অধ্যাপক ড. ডেভিড হজ জানিয়েছেন, “একটি লটারি টিকিট কেনার পর জেতার সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু এই গ্রহাণুর আঘাত হানার সম্ভাবনা এক মিলিয়ন গুণ বেশি।”
সম্ভাব্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা
যদি ঝুঁকি বাড়তে থাকে, তবে গ্রীষ্মের আগেই একটি বিশেষ টেলিস্কোপ পাঠিয়ে গ্রহাণুটিকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে। প্রয়োজনে একটি মহাকাশযান তৈরি করে সেটিকে গ্রহাণুর দিকে পাঠিয়ে এর গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করা হতে পারে। বৃহস্পতিবার ভিয়েনায় ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) নেতৃত্বাধীন স্পেস মিশন প্ল্যানিং অ্যাডভাইসরি গ্রুপ (SMPAG) বৈঠকে এই গ্রহাণুর ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই দলটি জাতিসংঘকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।
পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে গ্রহাণুটির কক্ষপথ ও সম্ভাব্য ঝুঁকি আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করা হবে। এই গবেষণায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপও যুক্ত হচ্ছে। এটি গ্রহাণুর আকার, গঠন ও গতি সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য দেবে।
মে মাসের পর, গ্রহাণুটি ২০২৮ সাল পর্যন্ত দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকবে, যা সম্ভাব্য সংঘর্ষের চার বছর আগে হবে। যদি তখনও এর আঘাতের ঝুঁকি শূন্য না হয়, তবে এটিকে পৃথিবীর পথ থেকে সরানোর জন্য মহাকাশযান পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এছাড়া, শুধুমাত্র ২০২৪ YR4-এর উপর নজরদারির জন্য একটি কাস্টম-নির্মিত টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণের সম্ভাবনাও আলোচনা করা হতে পারে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা টরিনো ইমপ্যাক্ট হ্যাজার্ড স্কেলে ২০২৪ YR4-এর ঝুঁকির স্তর ৩ নির্ধারণ করেছেন, যা বর্তমানে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা অন্য যেকোনো গ্রহাণুর মধ্যে সর্বোচ্চ।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল স্পেস অপারেশনস সেন্টারের সহ-প্রধান অ্যাঙ্গাস স্টুয়ার্ট বলেন, “আমরা প্রতিমাসে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০টি গ্রহাণুর পৃথিবীর পাশ দিয়ে নিরাপদে চলে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করি। ২০২৪ YR4-এর ঝুঁকি এখনো কম, তবে আমরা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে এর ওপর নজরদারি চালিয়ে যাব।” মে মাসে গ্রহাণুটি অদৃশ্য হওয়ার পরেও যদি এটি পৃথিবীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ থাকে, তবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থাগুলো এটিকে প্রতিহত করার বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করবে।
নাসার বিজ্ঞানীরা একটি গ্রহাণুর নমুনায় জীবনের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন