ছোট ছোট রোবটের একটি দলকে পিঁপড়ার মতো আচরণ করতে দেখে কি কখনো বিস্মিত হয়েছেন? দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা এমনই এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা স্বল্প পরিসরে বিশাল কর্মক্ষমতা দেখাতে সক্ষম। তাদের তৈরি মাইক্রো রোবটের দল পিঁপড়ার মতো একত্রে কাজ করে ভারী বস্তু বহন করতে পারে এবং জটিল পরিবেশে বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদন করতে সক্ষম।
এই প্রযুক্তিটি দক্ষিণ কোরিয়ার হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক এবং ন্যানো ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকদের প্রচেষ্টার ফল। ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ডিভাইস জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রোবটগুলো ঘূর্ণায়মান চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই পদ্ধতিতে একক রোবটের পক্ষে যে কাজগুলো একা করা সম্ভব নয় বা অত্যন্ত কঠিন, তা দলগত রোবটগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা সম্ভব হয়।। ভবিষ্যতে এই ছোট রোবটগুলো চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এগুলো ধমনীর ব্লক পরিষ্কার করতে বা জৈবিক নমুনা সুনির্দিষ্টভাবে স্থানান্তর করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মানে হলো, এই রোবটগুলো জটিল এবং সূক্ষ্ম চিকিৎসা কাজগুলো সম্পাদন করতে সহায়ক হবে, যা মানুষের জন্য ঝুঁকি এবং সময় কমাতে পারে।
আরও পড়ুনঃ চীনা পুলিশদের জন্য তৈরি করা হয়েছে রোবট পুলিশ
উচ্চ অভিযোজনক্ষমতা এবং কর্মক্ষমতা পরীক্ষার ফলাফল
গবেষণার প্রধান লেখক জেওং জায় উই জানিয়েছেন, মাইক্রো রোবট দলগুলোর পরিবেশের সাথে অভিযোজনক্ষমতা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের স্বায়ত্তশাসন স্তর অত্যন্ত চমকপ্রদ। গবেষণায় দেখা গেছে, এই রোবট দল উচ্চ আসপেক্ট রেশিও কনফিগারেশন ব্যবহার করে নিজের দৈর্ঘ্যের পাঁচগুণ উঁচু বাধা অতিক্রম করতে এবং একটি একটি করে সেই বাধার ওপরে উঠে যেতে সক্ষম। একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, ১,০০০ মাইক্রো রোবটের একটি দল পানিতে ভেসে একটি বড় ওষুধ বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যা প্রত্যেক রোবটের ওজনের ২,০০০ গুণ বেশি। শুকনো ভূমিতে, একটি রোবট দল তাদের একক ওজনের ৩৫০ গুণ ভারী বস্তু বহন করতে পেরেছে। আরেকটি রোবট দল এমন টিউব পরিষ্কার করেছে, যা ব্লক হওয়া ধমনী বা রক্তনালীকে অনুকরণ করে।
প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা এবং ভিন্নধর্মী নকশা
এই রোবট দলের কাজের পদ্ধতি মূলত পিঁপড়াদের সহযোগিতামূলক আচরণ থেকে অনুপ্রাণিত। পিঁপড়ারা যেমন একত্রে কাজ করে সেতু তৈরি করে বা ভেলার মতো আকৃতি ধারণ করে, তেমনই এই রোবট দলও দলগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করে। একটি দল ব্যর্থ হলে, অন্য সদস্যরা তাদের কাজ চালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগের গবেষণাগুলোতে গোলাকার রোবট নিয়ে কাজ করা হলেও, এখানে তারা বর্গাকার রোবট ডিজাইন করেছেন। বর্গাকার আকৃতির কারণে রোবটগুলোর চৌম্বকীয় সংযোগ শক্তিশালী হয়, কারণ পুরো পৃষ্ঠের সাথে সংযোগ স্থাপন সম্ভব। প্রতিটি মাইক্রো রোবটের উচ্চতা ৬০০ মাইক্রোমিটার এবং এর শরীর ইপক্সি দিয়ে তৈরি, যেখানে চৌম্বকীয় পদার্থ নডফেব (NdFeB) কণার সংমিশ্রণ রয়েছে।
পরিচালনার পদ্ধতি এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন
দুইটি সংযুক্ত চুম্বকের সাহায্যে তৈরি চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে এই রোবটগুলো চালানো হয়। গবেষকরা রোবটগুলোকে বিভিন্ন কনফিগারেশনে সাজানোর জন্য চৌম্বক ক্ষেত্রের কোণ পরিবর্তন করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে রোবট দল স্বল্প ব্যয়ে এবং সহজ পদ্ধতিতে একত্রিত হতে পারে। তবে এই প্রযুক্তির উন্নয়নে এখনও অনেক কাজ বাকি। রোবট দলগুলো এখনও তাদের নিজস্ব পরিবেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচল করতে পারে না। তাই গবেষকরা ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসনের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেবেন। উদাহরণস্বরূপ, রোবটের গতিবিধি এবং পথনির্দেশনার জন্য রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা হবে।
সম্ভাব্য ব্যবহার
এই মাইক্রো রোবট দল চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। বিশেষ করে ধমনীর ব্লক পরিষ্কার করা বা জটিল জৈবিক পরিবেশে ওষুধ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অসাধারণ হতে পারে। এছাড়া, এই প্রযুক্তি বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে যেমন জটিল সরঞ্জাম পরিচালনা, নমুনা সংগ্রহ বা ক্ষুদ্র অংশ স্থানান্তরে সহায়ক হতে পারে।
এ ধরনের উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও সহজ এবং কার্যকর করতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসন উন্নয়নের মাধ্যমে এই রোবট দল চিকিৎসা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
স্পর্শ ছাড়ায় বস্তু স্থানান্তর করা যাবে কিরিগামি ডিজাইন এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে