জ্যোতির্পদার্থবিদরা কসমিক স্ট্রিং এর সনাক্তকরণ নিশ্চিত করেছেন

মহাবিশ্বের প্রথম দিককার ঘটনা এবং এর গভীর রহস্যময় গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণা করে আসছেন। সেই গবেষণার অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে কসমিক স্ট্রিংস বা মহাজাগতিক সুতো। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ টম কিবল এবং অন্যান্য গবেষকরা প্রথম কসমিক স্ট্রিংসের ধারণা দেন। তারা বলেছিলেন, মহাবিশ্বের জন্মের পরে যে বিশাল তাপমাত্রা এবং শক্তির পরিবর্তন ঘটে, তার ফলস্বরূপ সময়-স্থান বা স্পেসটাইমে কিছু ত্রুটি সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের ত্রুটিই কসমিক স্ট্রিংস নামে পরিচিত।

একটি বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যা আমরা বিগ ব্যাং নামে জানি, এই বিস্ফোরণের পরে প্রথম সেকেন্ডের মধ্যেই মহাবিশ্বের তাপমাত্রা অতি উচ্চমাত্রায় ছিল। এই সময়ে মহাবিশ্ব একটি কোয়ান্টাম ফিল্ডের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল, যেখানে ফেজ ট্রানজিশন বা পর্যায় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ঘটে। এটি অনেকটা পানির বাষ্পে পরিণত হওয়ার মতো একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু এর তাপমাত্রা ছিল অবিশ্বাস্যভাবে বেশি। এই ফেজ ট্রানজিশনের সময় স্পেসটাইমে যে ত্রুটি তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই কসমিক স্ট্রিংস।

আরও পড়ুনঃ আদি কৃষ্ণগহ্বরগুলো মহাকাশে শূন্য গহ্বরবিশিষ্ট গ্রহাণু তৈরি করতে পারে

১৯৭৬ সালে টম কিবল প্রথম এই তত্ত্ব দেন। তার মতে, বিগ ব্যাং-এর পরে মহাবিশ্ব যখন ঠান্ডা হতে শুরু করে, তখন এটি বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে মহাবিশ্বে এমন কিছু এক-মাত্রিক গঠন তৈরি হতে পারে যেগুলোর ঘনত্ব এবং শক্তি অত্যন্ত বেশি। এই গঠনগুলোকেই কসমিক স্ট্রিংস বলা হয়। ১৯৮০-এর দশকে আলেকজান্ডার ভিলেনকিন এই তত্ত্বকে আরও বিকাশ করেন এবং দেখান যে কসমিক স্ট্রিংস মহাবিশ্বের বৃহৎ আকারের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের এক ধারা সুপারস্ট্রিং থিওরির সাথে কসমিক স্ট্রিংসের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষক এডওয়ার্ড উইটেন এবং তার সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে কসমিক স্ট্রিংস সুপারস্ট্রিং থিওরির বহুমাত্রিক কণার ধারণার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। যদিও ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে ইনফ্লেশন মডেলের কারণে কসমিক স্ট্রিংসের ধারণাটি কিছুটা চাপা পড়ে, তবুও উচ্চ-শক্তি পদার্থবিজ্ঞান এবং মহাবিশ্বের প্রথম দিককার অবস্থার গবেষণায় এর গুরুত্ব অটুট থাকে।

বিগত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা কসমিক স্ট্রিংস শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। লিগো এবং ভার্গোর মতো গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টর এবং কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) বিশ্লেষণ ব্যবহার করে তারা কসমিক স্ট্রিংসের প্রমাণ খুঁজেছেন। ২০০০-এর দশকে থিবল ডামুর এবং আলেকজান্ডার ভিলেনকিন দেখান যে কসমিক স্ট্রিংস থেকে নির্গত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি।

সম্প্রতি, ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান একটি যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে। তারা প্রথমবারের মতো কসমিক স্ট্রিংসের অস্তিত্বের সম্ভাব্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে। এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। তারা জানিয়েছেন, SDSSJ110429.61+233150.3 নামে পরিচিত দুটি আলোকময় গ্যালাক্সি আসলে একটি মাত্র গ্যালাক্সি, যা কসমিক স্ট্রিংসের কারণে দুটি আলাদা চিত্রে বিভক্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামে পরিচিত।

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যেখানে মহাজাগতিক বস্তুগুলোর ভর থেকে সৃষ্ট মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পেছনের বস্তুগুলোর আলোকে বেঁকিয়ে দেয়। সাধারণত এটি বৃহৎ গ্যালাক্সি ক্লাস্টার দ্বারা সংঘটিত হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে গবেষকরা বলছেন, আলো বিকৃত করার পেছনে কসমিক স্ট্রিংস ভূমিকা পালন করেছে। তারা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে SDSSJ110429 গ্যালাক্সি জোড়ার আলোক বর্ণালী প্রায় অভিন্ন। তাদের মতে, এটি গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের কারণে ঘটে থাকতে পারে।

গবেষকরা বলেছেন, এই আবিষ্কার আরও তদন্তের দাবি রাখে। তারা উন্নত পর্যবেক্ষণের জন্য ৪-মিটার ক্লাসের টেলিস্কোপ ব্যবহার করার সুপারিশ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপ এই কাজে সহায়ক হতে পারে।

যদিও এই গবেষণাটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং সমালোচনা বা পর্যালোচনার অপেক্ষায়, এটি কসমিক স্ট্রিংসের অস্তিত্ব প্রমাণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং এর গঠন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে।

কসমিক স্ট্রিংস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও সীমিত। এটি এক ধরনের তাত্ত্বিক ধারণা, যা মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার রহস্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে। যদিও এই তত্ত্ব প্রমাণিত হয়নি, তবে সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলো আমাদের আশা জাগায়। ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি এবং আরও গবেষণার মাধ্যমে হয়তো আমরা কসমিক স্ট্রিংসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারব এবং মহাবিশ্বের গভীর রহস্যের আরও কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব।

৮০ বছর পর নোভা সংগঠিত হতে পারে “টি করোনাই বোরেলিস” নক্ষত্রে

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো