প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে কৌতূহলী ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সামনে আসে এই বিগ ব্যাং তত্ত্ব। বিগ ব্যাং হলো এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্ব প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘন ও উষ্ণ অবস্থায় ছিলো, যাকে “প্রাইমেভাল এটম” বা প্রাথমিক কণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অশেষ তাপ, শক্তি এবং ঘনত্ব, যেখান থেকে মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদান ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। ১৯২০-এর দশকে বেলজিয়ামের প্রফেসর ও পুরোহিত জর্জ লেমেট্র প্রথমবার এই ধারণাটি প্রস্তাব করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মহাবিশ্বে উপস্থিত গ্যালাক্সিগুলির গতিপথ পরিমাপ করে এটির সম্প্রসারণের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরে, ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল গ্যালাক্সিগুলির থেকে বের হওয়া লালচে বিকিরণের পর্যবেক্ষণ করেন, যা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছিল যে প্রতিটি গ্যালাক্সি একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ বিগ ব্যাং তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অতঃপর, ১৯৬৫ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন দ্বারা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন আবিষ্কার করা হয়। এই রেডিয়েশনের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মহাবিশ্ব এক সময় এতটাই উষ্ণ ও ঘন ছিল যে এখনও তার অবশিষ্টাংশ রুপে শীতল পরিমণ্ডলে বিক্ষিপ্ত আছে। এভাবেই মহাবিশ্বের উদ্ভব এবং তার বিস্তারের প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পদার্থের মৌলিক কণা এবং তাদের বিকিরণ সংক্রান্ত তত্ত্ব। প্রথম কণা তৈরি হওয়ার পর, সময়ের সাথে সাথে হালকা মৌলক যেমন হাইড্রোজেন ও হেলিয়াম, পরে ভারী মৌলকের সৃষ্টিতে পরিণত হয়। এই তত্ত্বটি মহাবিশ্বের বর্তমান রুপ-রেখা এবং তার জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে সহায়ক। তত্ত্বটি সারা বিশ্বে মহাজাগতিক কক্ষচিত্র, গ্যালাক্সি বিন্যাস ও নক্ষত্র বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবর্তক ও ইতিহাস
বিগ ব্যাং তত্ত্বের মূল ধারণাটি প্রবর্তন করেন জর্জ লেমেট্র, যিনি ১৯২৭ সালে “প্রাইমেভাল এটম” ধারণাটি প্রস্তাব করেন। লেমেট্র ছিলেন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে অদ্বিতীয় প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মহাবিশ্বের বিস্তারের সূত্রধর এই প্রাথমিক কণা থেকেই উদ্ভব পেয়েছে। তাঁর কাজকে সমর্থন করে এডউইন হাবলের পর্যবেক্ষণ, যা মহাবিশ্বের বিস্তারকে সরাসরি প্রমাণ করে।
তবে, “বিগ ব্যাং” শব্দটি নিজে কোন প্রবর্তকের নাম নয়; এই শব্দটি বিখ্যাত ব্রিটিশ শাস্ত্রবিদ ফ্রেড হোয়েল ব্যবহার করেছিলেন, যিনি মূলত স্থির অবস্থার তত্ত্বের পক্ষে ছিলেন। হোয়েলের সমালোচনার পাশাপাশি তিনি এই নামটি ব্যবহৃত করে সৃষ্টির বিস্তারকে ব্যঙ্গাত্মক রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তথাপি, আজকের দিনে জর্জ লেমেট্রের কাজ এবং হাবলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিগ ব্যাং তত্ত্ব সর্বজনীনভাবে গ্রহণ্য হয়েছে।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব শুধু মহাবিশ্বের বিস্তার ব্যাখ্যা করে না, বরং এটি মহাবিশ্বের ইতিহাস, গঠন এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা প্রদান করে। এই তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের প্রথম কিছু মুহূর্ত ছিল এতটাই অস্থির ও উষ্ণ যে, তাত্ত্বিকভাবে সেই মুহূর্তগুলোকে “ইনফ্লেশন এর যুগ” বলা হয়, যেখানে মহাবিশ্ব অত্যন্ত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। এই ইনফ্লেশন তত্ত্ব থেকেই আধুনিক মহাজাগতিক মডেলটির অনেক উপাদান নির্ধারিত হয়।
আরো পড়ুনঃ আমাদের মহাবিশ্ব কত বড়? কি কেন ও কিভাবে?
কুরআনে বিগ ব্যাং তত্ত্বের ব্যাখ্যা
ইসলামী ঐতিহ্যে কুরআন আলীকে বিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য অপরিসীম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিস্তারের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদরা বিগ ব্যাং তত্ত্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করেন।
উদাহরণস্বরূপ, সূরা আধ্য-ধারীয়াত (সুরা ৫১, আয়াত ৪৭) এর একটি অংশে বলা হয়েছে, “وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ” – যার মানে, “আমি আকাশকে এমনভাবে নির্মাণ করেছি, এবং নিঃসন্দেহে আমি বিস্তারকারী।” অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন যে, এখানে ব্যবহৃত “বিস্তারকারী” শব্দটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কুরআনের এই আয়াতটি বিগ ব্যাং তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক উপাদানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে মহাবিশ্বের বিস্তার ক্রমাগত চলছে।
এছাড়া, ইসলামী ঐতিহ্যে সৃষ্টির ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি এবং ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। তবে, আধুনিক বিজ্ঞান যেমন মহাবিশ্বের গঠন, নক্ষত্রপিণ্ডের সৃষ্টি ও গ্যালাক্সির গতিপথের বিষয়ে যে তথ্যাদি উপস্থাপন করে, তা অভূতপূর্ব এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। ফলে, অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী আজ বিগ ব্যাং তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার দিক থেকে গ্রহণ করতে উৎসাহিত হন, যা কুরআনের আধ্যাত্মিক বার্তা ও বিজ্ঞানের উপাদানের মধ্যে এক সেতুবন্ধনের প্রস্তাব করে।
সমসাময়িক গবেষণা
বর্তমান সময়ে মহাবিশ্বের বিস্তারের তত্ত্বে নতুন নতুন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ যুক্ত হচ্ছে। মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড, গামা রে বিস্ফোরণ ও নক্ষত্রের গঠন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলমান। এ গবেষণাগুলি বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিভিন্ন দিককে সমর্থন করে এবং তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণাগুলোকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।
সংক্ষেপে বলা যায়, বিগ ব্যাং তত্ত্ব বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিস্তারের ব্যাখ্যা প্রদান করে, যেখানে কুরআনের আয়াতগুলি আধ্যাত্মিক ও প্রতীকী বার্তা বহন করে। জর্জ লেমেট্রের উদ্ভাবনী চিন্তা, এডউইন হাবলের পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তীতে পেনজিয়াস-উইলসনের আবিষ্কারের মাধ্যমে বিগ ব্যাং তত্ত্ব আজকের দিনে সারা বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। অপরদিকে, কুরআনের সৃষ্টি বর্ণনা মানবজাতির আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও নৈতিকতা গঠনে অবিচ্ছেদ্য অংশীদার।
এই প্রবন্ধে তুলে ধরা তথ্যাদি ও বিশ্লেষণ শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এখানে কোনো অনুমানমূলক তথ্য প্রদান করা হয়নি, বরং প্রামাণ্য সূত্র ও পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব ও কুরআনের আয়াতসমূহের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, মানবজাতির চিন্তাধারা কতটা বহুমুখী ও গভীর, যেখানে বিজ্ঞানের নির্ভুলতা ও ধর্মের আধ্যাত্মিকতা একে অপরকে পরিপূরক করতে সক্ষম।
মহাবিশ্বের অসীম সীমানা ও অজানা আরো অনেক তথ্য জানুন কি কেন ও কিভাবে