ব্ল্যাক হোল কি কেন ও কিভাবে? ব্ল্যাক হোল এর পুরো ইতিহাস

ব্ল্যাক হোল কি?

ব্ল্যাক হোল হলো মহাকাশের এমন একটি স্থান যেখানে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে আলো পর্যন্ত তা থেকে পালাতে পারে না। এটি এমন এক বস্তু যা এত বেশি ঘন এবং এর ভর এত বেশি যে কোনো কিছুই, এমনকি আলোক কণাও, এর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে পারে না। সাধারণত ব্ল্যাক হোল গঠিত হয় মৃত তারার কেন্দ্রীভূত ভর থেকে, যখন সেই তারা তার জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ব্ল্যাক হোলের প্রান্তে একটি সীমা রয়েছে, যা “ইভেন্ট হরাইজন” নামে পরিচিত। ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে কোনো কিছুই ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এই প্রান্তের পেছনে কী ঘটছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা জল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ ১১তম ডাইমেনশন কি? ডাইমেনশনের মাধ্যমে কিভাবে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়?

ব্ল্যাক হোল আবিষ্কারের ইতিহাস

ব্ল্যাক হোলের ধারণাটি প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ১৭৮৩ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন মিচেল দ্বারা। তিনি বলেছিলেন, যদি কোনো বস্তুর ভর এবং ঘনত্ব এত বেশি হয় যে এর পালানোর গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি হয়, তবে সেই বস্তুটি হবে একটি ব্ল্যাক হোল। পরবর্তী সময়ে, ১৯১৫ সালে, আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্ল্যাক হোলের ধারণাকে আরও সুসংহত করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভরযুক্ত বস্তু সময় এবং স্থানের কাঠামোকে বিকৃত করে। এই বিকৃতি এতটাই গভীর হতে পারে যে কোনো কিছুই সেখান থেকে পালাতে পারে না। ব্ল্যাক হোলের আধুনিক গবেষণার সূচনা হয় ১৯৩৯ সালে, যখন রবার্ট ওপেনহাইমার এবং তার সহযোগীরা প্রথম গণিতের সাহায্যে দেখান যে একটি তারার ভর সংকোচনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলে রূপান্তরিত হতে পারে। ১৯৬০-এর দশকে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজের গবেষণার মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল তত্ত্ব আরো দৃঢ় হয়। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো একটি ব্ল্যাক হোলের ছবি ধারণ করা হয়। এটি মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে একটি মাইলফলক।

ব্ল্যাক হোল কালো হয় কেন?

ব্ল্যাক হোল কালো হয় কারণ এটি এত শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করে যে এটি আলোককণাসহ সব কিছু শোষণ করে নেয়। আলোর শোষণের কারণে ব্ল্যাক হোল কোনো প্রতিফলন বা বিকিরণ সৃষ্টি করতে পারে না, যা এটিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার দেখায়। এর ইভেন্ট হরাইজনের পেছনে যা কিছু ঘটে, তা আমাদের কাছে অদৃশ্য থাকে, কারণ কোনো আলো বা তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না।

ব্ল্যাক হোল কিভাবে সৃষ্টি হয়?

ব্ল্যাক হোল মূলত একটি তারার মৃত্যু থেকে সৃষ্ট হয়। একটি তারার জ্বালানি (হাইড্রোজেন) শেষ হয়ে গেলে, তার মধ্যবর্তী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার বাইরের স্তরের চাপে ভেঙে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় কয়েকটি ধাপ রয়েছে:

  • তারার সংকোচন: বড় তারাগুলো যখন তাদের জ্বালানি ব্যবহার শেষ করে ফেলে, তখন তাদের মাধ্যাকর্ষণ বল তাদের বাইরের স্তরকে কেন্দ্রীয় অংশে টেনে আনে। তারার ভেতরের নিউক্লিয়ার জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং পুরো তারা সংকুচিত হয়ে ছোট একটি ভর কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ার সময় তারার তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব এত বেশি হয়ে যায় যে এটি নিজেকে ধারণ করতে পারে না।
  • সুপারনোভা বিস্ফোরণ: বড় তারাগুলো এক পর্যায়ে ভেঙে পড়ে এবং একটি শক্তিশালী সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তারার বাইরের স্তর মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় তারার কেন্দ্রীয় অংশে একটি সংকুচিত কোর রয়ে যায়, যা ব্ল্যাক হোলের জন্ম দেয়।
  • নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাক হোলের গঠন: যদি তারার ভর খুব বেশি হয়, তাহলে এটি একটি নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। তারার ভরের উপর নির্ভর করে এটি হয়তো ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে পারে। ব্ল্যাক হোলে পরিণত হলে, এটি মহাকর্ষের প্রভাবে পুরো ভর কেন্দ্রীভূত করে ফেলে।

ব্ল্যাক হোল গঠনের আরেকটি উপায় হলো গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বৃহৎ পরিমাণে গ্যাস এবং ধূলিকণার সংকোচন, যা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল তৈরি করে।

এলিয়েন কি সত্যি আছে? কোরআন ও বিজ্ঞান কি বলে জেনে নিন

ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি আছে?

ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কী আছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন। তবে সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে একটি “সিঙ্গুলারিটি” রয়েছে। সিঙ্গুলারিটি হলো এমন একটি বিন্দু যেখানে ভর অসীম এবং স্থান-কাল বিকৃত হয়ে যায়। এটি একটি বিশেষ জায়গা যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের পরিচিত নিয়ম কাজ করে না।

ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের পেছনের ঘটনা বিজ্ঞানীরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। তবে ব্ল্যাক হোলের আশেপাশের গ্যাস, ধূলিকণা এবং আলোর আচরণ পর্যবেক্ষণ করে আমরা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারি।

ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ

ব্ল্যাক হোল সাধারণত তিনটি প্রকারে বিভক্ত হয়:

১। স্টেলার ব্ল্যাক হোল: এগুলো বড় তারার মৃত্যু থেকে গঠিত হয়। এর ভর সাধারণত কয়েকগুণ সূর্যের ভরের সমান।

২। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল: এগুলো গ্যালাক্সির কেন্দ্রে পাওয়া যায় এবং এদের ভর কয়েক মিলিয়ন থেকে কয়েক বিলিয়ন সূর্যের ভরের সমান।

৩। মধ্যম ভরের ব্ল্যাক হোল: স্টেলার এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের মধ্যে অবস্থান করে। এদের সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি।

ব্ল্যাক হোলের প্রভাব

ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে থাকা বস্তুগুলোর উপর এর মাধ্যাকর্ষণীয় প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। এটি আশেপাশের গ্যাস এবং ধূলিকণাকে আকর্ষণ করে একটি ডিস্ক তৈরি করে, যা “অ্যাক্রিশন ডিস্ক” নামে পরিচিত। এই ডিস্ক থেকে এক্স-রে এবং আলোর ঝলক নির্গত হয়, যা বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন।

ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণ

ব্ল্যাক হোল সরাসরি দেখা সম্ভব নয় কারণ এটি আলো শোষণ করে। তবে বিজ্ঞানীরা এর চারপাশের বস্তু এবং বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ২০১৯ সালে, ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ একটি ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি ধারণ করে, যা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্ল্যাক হোল শুধুমাত্র গবেষণার বিষয় নয়, এর ব্যবহারিক দিকও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ব্ল্যাক হোলের মাধ্যমে সময় ও স্থানের বিকৃতি বোঝা যায়। এটি মহাকাশ ভ্রমণের জন্য নতুন মাধ্যম হতে পারে। মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং গঠন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে।

ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের এক অপার রহস্য। এটি আমাদের মহাকাশ এবং পদার্থবিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের গঠন, প্রভাব এবং এর ভিতরের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এর ফলে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারব।

টাইম মেশিন তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব ? কি কেন ও কিভাবে

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো