ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সান দিয়েগোর গবেষকরা একটি শরীরে পরিধানযোগ্য রক্তচাপ মাপার যন্ত্র আল্ট্রাসাউন্ড প্যাচ উদ্ভাবন করেছেন যা রক্তচাপ পরিমাপের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উন্নয়ন। এটি একটি নন-ইনভেসিভ (অপ্রবেশযোগ্য) পদ্ধতিতে রক্তচাপ পরিমাপ করতে সক্ষম, যা প্রচলিত রক্তচাপ মাপার পদ্ধতির তুলনায় আরও কার্যকর এবং ব্যবহারবান্ধব। এই প্যাচটি বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ও বাস্তবজীবনের পরীক্ষায় সফলভাবে যাচাই করা হয়েছে।
এই প্যাচটি একটি ছোট এবং নমনীয় ডিভাইস যা ত্বকের সাথে লেগে থাকে। এটি একটি পোস্টেজ স্ট্যাম্পের সমান আকৃতির এবং এটি হাতের নীচের অংশে ব্যবহার করা হয়। প্যাচটি সিলিকন ইলাস্টোমার দিয়ে তৈরি, যেখানে ছোট পাইজোইলেকট্রিক ট্রান্সডিউসারের একটি ধারা রয়েছে। এই ট্রান্সডিউসারগুলো আল্ট্রাসাউন্ড তরঙ্গ প্রেরণ এবং গ্রহণ করে রক্তনালীর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে, এর মাধ্যমে রক্তনালীর ব্যাস পরিবর্তন নিরীক্ষণ করা হয় এবং সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে রক্তচাপের সঠিক মান নির্ধারণ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ ব্রেইন এন্ডিউরেন্স ট্রেনিং (BET): বয়স্কদের মস্তিষ্ক এবং শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির এক নতুন পদ্ধতি
গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি এমন প্রযুক্তি তৈরি করা যা রক্তচাপের নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। প্রচলিত রক্তচাপ মাপার পদ্ধতিগুলো যেমন কফ ব্যবহার করে এককালীন রক্তচাপ মাপা হয়, যা অনেক সময় রক্তচাপের প্রকৃত পরিবর্তন বা ওঠানামার ধরণ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। নতুন এই প্যাচের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক তথ্যপ্রবাহ পাওয়া যায় যা রক্তচাপের সূক্ষ পরিবর্তনও তুলে ধরতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্যাচটি প্রচলিত রক্তচাপ মাপার কফ এবং আর্টেরিয়াল লাইনের মতো উন্নত চিকিৎসা ডিভাইসগুলোর একই রকম কার্যকর ফলাফল প্রদান করেছে। আর্টেরিয়াল লাইন, যা ইনভেসিভ এবং ব্যথাজনক, সাধারণত শুধুমাত্র আইসিইউ এবং অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত হয়। এর বিকল্প হিসেবে প্যাচটি সহজ এবং আরামদায়ক হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষকরা প্যাচটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে ১১৭ জন রোগীর উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন। পরীক্ষাগুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন দৈনন্দিন কার্যক্রম যেমন সাইক্লিং, হাত বা পা তোলা, মানসিক গাণিতিক সমাধান, ধ্যান, খাবার গ্রহণ এবং এনার্জি ড্রিংক পান। এছাড়াও, একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর উপর প্যাচটি বসা থেকে দাঁড়ানোর মতো শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনের সময় পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষায় প্যাচের ফলাফল রক্তচাপ মাপার প্রচলিত কফের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
বিশেষত, এটি ধ্যান এবং মানসিক চাপের সময় রক্তচাপের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এটি দেখায় যে প্যাচটি শুধু চিকিৎসকের ব্যবহারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্যও উপযুক্ত। রোগীরা এটি ব্যবহার করে প্রতিদিনের রুটিনে নিজেদের রক্তচাপের প্রবণতা নিরীক্ষণ করতে পারবেন।
এই প্যাচটি আরও নির্ভুল করার জন্য গবেষকরা দুইটি প্রধান প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছেন। প্রথমত, ট্রান্সডিউসারগুলোকে আরও ঘনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা ছোট রক্তনালী যেমন ব্র্যাকিয়াল এবং রেডিয়াল আর্টারির রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে কার্যকর। দ্বিতীয়ত, একটি ব্যাকিং লেয়ার যোগ করা হয়েছে, যা ট্রান্সডিউসারের অপ্রয়োজনীয় কম্পন দূর করে সংকেতের গুণগত মান উন্নত করে। এটি ডিভাইসটির কার্যক্ষমতা আরও উন্নত করেছে এবং এটি বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পরিবেশে ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে।
কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাবরেটরি এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীদের উপর প্যাচটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোতে প্যাচের ফলাফল আর্টেরিয়াল লাইনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে গেছে। গবেষণার সহ-প্রধান লেখক সাই জোউ বলেন, “এই প্যাচটি রক্তচাপ পরিবর্তনের বিশদ প্রবণতা নির্ণয়ে সহায়ক, যা প্রচলিত পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এটি রোগীর জন্য আরও সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।”
গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি নন-ইনভেসিভ পদ্ধতিতে রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে রক্তচাপ মাপার সময় অনেক রোগী অস্বস্তি অনুভব করেন। কিন্তু এই প্যাচটি আরামদায়ক এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় রোগীদের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণা দলটি এখন বড় পরিসরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ডিভাইসটির সক্ষমতা বাড়াতে মেশিন লার্নিং সংযোজনের পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি, একটি ওয়্যারলেস, ব্যাটারি-চালিত সংস্করণ তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার এবং বিদ্যমান হাসপাতাল ব্যবস্থার সাথে সহজে সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হবে। মেশিন লার্নিং যুক্ত হলে ডিভাইসটি আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে এবং রোগীর জন্য আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করতে পারবে।
জিএলপি-১ বেসড থেরাপির মাধ্যমে ওজন কমানোর পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিও হ্রাস পায়
নতুন এই প্যাচটি রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু চিকিৎসকদের কাজই সহজ হবে না, বরং রোগীরাও বাসায় থেকে নিজের রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এটি বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রোগীরা এটি ব্যবহার করে চিকিৎসকের সাথে তথ্য ভাগাভাগি করতে পারবেন, যা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
এই প্রযুক্তি রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি আনবে। এটি শুধু রোগীদের জীবনমান উন্নত করবে না, বরং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে। ভবিষ্যতে, এই ধরনের প্রযুক্তি আরও উন্নত এবং সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়, যা সর্বস্তরের মানুষের জন্য সহজলভ্য হবে।
আরও পড়ুনঃ পদার্থবিদরা সময় পরিমাপের একটি নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছেন