চীনের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি অত্যাধুনিক ফটনিক মিলিমিটার-ওয়েভ রাডার চিপ উদ্ভাবন করেছেন, যা ভবিষ্যতের 6G যোগাযোগ, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালনা ও অন্যান্য সঠিক সেন্সর প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। নানকাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি ইউনিভার্সিটি অফ হংকং এর গবেষকরা এই চিপের নকশা ও উন্নয়নে কাজ করেছেন। গবেষণাপত্রটি Nature Photonics জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক দুনিয়ায় এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কতটুকু তা প্রমাণ করে। এই নতুন চিপটির মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ৪ ইঞ্চির থিন-ফিল্ম লিথিয়াম নিয়োবেট (TFLN) প্ল্যাটফর্ম। লিথিয়াম নিয়োবেটের বিশেষত্ব হলো এটি আলোর ও বৈদ্যুতিক সংকেতের সাথে কাজ করতে অসাধারণ সক্ষমতা রাখে। এই প্ল্যাটফর্মটি সিএমওএস (CMOS) প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে, এই চিপটি ব্যাপক পরিসরে উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত।
নতুন চিপটি উচ্চমানের সেন্সর প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে, যা সেমি-সেন্টিমিটার রেজোলিউশনে দূরত্ব ও গতি পরিমাপ করতে পারে। চিপটি দুই-মাত্রিক (২ডি) ইমেজিংয়ের ক্ষেত্রেও ভালো কাজ করে। এটি ইনভার্স সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার (ISAR) নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে জটিল পরিবেশে বস্তুগুলোর বিস্তারিত ছবি তোলা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে, রাডার সিগন্যালকে বিভিন্ন কোণ থেকে সংগ্রহ করে, একটি সম্পূর্ণ ও বিশদ ছবি তৈরি করা হয়।
গবেষকরা এই চিপটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পরীক্ষা পরিচালনা করেন। পরীক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল: দূরত্ব পরিমাপ, বস্তুর গতি নির্ণয় এবং ISAR ইমেজিং পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় দেখা যায়, চিপটি অত্যন্ত নির্ভুলভাবে বস্তুর দূরত্ব ও গতি পরিমাপ করতে পারে এবং স্পষ্ট, উচ্চ-সংজ্ঞার ছবি তৈরি করে। এমন বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সঠিক সেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিরাপত্তা ও নেভিগেশনের মান বৃদ্ধি পায়।
চীনের বিজ্ঞানীরা চিপটির নকশায় দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ একত্রিত করেছেন। প্রথমটি হলো ফ্রিকোয়েন্সি মাল্টিপ্লিকেশন, যার মাধ্যমে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির মিলিমিটার-ওয়েভ সিগন্যাল তৈরি করা হয়। দ্বিতীয়টি হলো ইকো ডি-চিরপিং, যা প্রতিফলিত সিগন্যালগুলিকে প্রক্রিয়াজাত করে এবং লক্ষ্যবস্তুর সঠিক দূরত্ব ও গতি নির্ধারণ করে। এই দুইটি কার্যকলাপ একত্রে কাজ করার ফলে, চিপটি সিগন্যাল তৈরি, প্রক্রিয়াকরণ ও গ্রহণের কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে।
গবেষক জু শা, যিনি নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং এই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান সদস্য, তিনি বলেন, “এই চিপটি রাডার প্রযুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটি শুধু প্রচলিত ইলেকট্রনিক রাডার সিস্টেমের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠছে না, বরং এক কমপ্যাক্ট ও উচ্চ-প্রদর্শনক্ষম ফটনিক রাডার সিস্টেমের নতুন মান স্থাপন করছে।”
ফটনিক রাডার চিপটি আগামীতে 6G যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 6G প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, যা দ্রুত ডেটা ট্রান্সমিশন ও কম ল্যাটেন্সির সুবিধা প্রদান করবে। এই চিপটি সেই উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শন করে, যা ভবিষ্যতের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে পারে।
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ও অন্যান্য নিরাপত্তা-নির্ভর প্রযুক্তিতেও এই চিপটির গুরুত্ব অপরিসীম। স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলোতে রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে রাস্তার অবস্থা, আশপাশের যানবাহন ও বাধা নির্ণয় করা হয়। এই চিপটি সেন্টিমিটার-স্তরের সঠিকতা সহকারে রাডার সিগন্যাল তৈরি করতে ও প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম। ফলে, স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলোর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা আরও বাড়বে, এবং সেগুলো জটিল পরিবেশেও নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারবে।
এই প্রযুক্তির আরেকটি সুবিধা হলো এটি ছোট ও শক্তি সাশ্রয়ী। বর্তমান ইলেকট্রনিক রাডার সিস্টেমগুলোর তুলনায়, এই ফটনিক রাডার চিপটি অনেক কম জায়গা নেয় এবং এর শক্তি ব্যবহারও কম। ফলে, এটি পোর্টেবল বা মোবাইল ডিভাইসগুলোর সাথে সহজেই যুক্ত করা যায়, যা ভবিষ্যতে আরও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
ফটনিক প্রযুক্তি এবং মিলিমিটার-ওয়েভ রাডারের সংমিশ্রণে নতুন এই উদ্ভাবন শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শিল্প স্বয়ংক্রিয়তা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কারখানায় উৎপাদন লাইনের গুণগতমান পর্যবেক্ষণে এই চিপটি ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি বা অসামঞ্জস্যতা দ্রুত সনাক্ত করা যায়। এছাড়া, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তি তৈরিতে এই চিপটির ব্যবহার নতুন রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসা প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে।
সবশেষে, এই উদ্ভাবন প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা কিভাবে আমাদের জীবনকে আরও উন্নত, নিরাপদ ও সহজ করতে পারি। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায়, আগামী দিনগুলিতে আমরা আরও অনেক নতুন ও কার্যকর প্রযুক্তির সাক্ষী হবো, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে প্রতিটি নতুন উদ্ভাবন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন দিশা ও সম্ভাবনা উন্মোচন করে।
চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন