মঙ্গলের মতো কঠিন পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি উৎস/ব্যাটারি তৈরি করা চিরকাল বিজ্ঞানীদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। মঙ্গলের গ্যাস সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল এবং তাপমাত্রার বড় পরিবর্তনের কারণে সেখানে শক্তি উৎপাদন ও সঞ্চয় করা খুবই কঠিন। সম্প্রতি, চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (USTC) গবেষকরা একটি নতুন ধরণের ব্যাটারি তৈরি করেছেন যা মঙ্গলের পরিবেশে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। এই গবেষণাটি মঙ্গলের মতো কঠিন পরিবেশে শক্তি উৎপাদনের ভবিষ্যত সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে।
গবেষক দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রফেসর পেং তান, এবং এই গবেষণা চীনের একাডেমি অফ সায়েন্সেসের (CAS) অংশ। নতুন ব্যাটারিটি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলকে সরাসরি ব্যবহার করে, যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৯৫.৩২%। এই ব্যাটারিটি লিথিয়াম এবং কার্বন ডাই অক্সাইডকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে। গবেষণার ফলাফল “সায়েন্স বুলেটিন” নামক একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরণ এর ঝুঁকি আর থাকবেনা
মঙ্গলের তাপমাত্রা খুবই পরিবর্তনশীল এবং বায়ুমণ্ডলেও অনেক ধরনের গ্যাস থাকে। মঙ্গলের তাপমাত্রা ০–৬০℃ এর মধ্যে থাকে, যা শক্তি উৎপাদনের যন্ত্রগুলোর কর্মক্ষমতাকে অনেক প্রভাবিত করে। তাই বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের প্রকৃত পরিবেশের সাথে মিল রেখে ব্যাটারিটির নকশা করেছেন, যাতে এটি কঠিন তাপমাত্রাতেও কার্যকর থাকে। এই ব্যাটারিটি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলকে সরাসরি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। গবেষকরা ব্যাটারিটি মঙ্গলের তাপমাত্রার নিচে পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেখানে ০℃ তাপমাত্রায় এর শক্তি ঘনত্ব (energy density) ছিল ৩৭৩.৯ ওয়াট ঘণ্টা/কেজি এবং এর চক্রায়িত জীবনকাল ছিল প্রায় ১৩৭৫ ঘণ্টা, যা প্রায় দুই মঙ্গল মাসের সমান।
এই ব্যাটারিটি লিথিয়াম কার্বনেট তৈরি ও ভাঙার মাধ্যমে চার্জিং ও ডিসচার্জিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এতে একটি ইন্টিগ্রেটেড ইলেক্ট্রোড তৈরির ব্যবস্থা এবং ভাঁজ করা যায় এমন ব্যাটারির গঠন ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাটারিটির আকার বড় করা সম্ভব হয়েছে (২×2 সেন্টিমিটার), যা শক্তি ঘনত্বকে আরও বাড়িয়ে ৭৬৫ ওয়াট ঘণ্টা/কেজি এবং ৬৩০ ওয়াট ঘণ্টা/লিটার পর্যন্ত উন্নীত করেছে। মঙ্গলের আবহাওয়া অনেকটা পৃথিবীর তুলনায় ভিন্ন এবং শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজনও আলাদা। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রধান উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইড, যা পৃথিবীতে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। তাই গবেষকরা এই বায়ুমণ্ডলকে সরাসরি ব্যবহার করার উপায় বের করেছেন, যা মঙ্গলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
এই নতুন ধরণের ব্যাটারিটি দীর্ঘস্থায়ী শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এটি মঙ্গলের কঠিন পরিবেশে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিকে শক্তি সরবরাহ করতে পারে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে, মঙ্গলে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা করতে এবং দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা চালাতে এর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে।
গবেষণাটি মঙ্গলের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে শক্তি ব্যবস্থাপনা এবং মঙ্গল অভিযানের ভবিষ্যত প্রজেক্টগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। এতে আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে টেকসই শক্তির উৎস নিশ্চিত করতে এই ব্যাটারির বিকাশ এবং ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মঙ্গলের পরিবেশে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী শক্তি সরবরাহ এবং শক্তির চাহিদা মেটাতে বহুমুখী শক্তির ব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ, ভবিষ্যতে মঙ্গলে আরও শক্তি উৎপাদনের জন্য সৌরশক্তি, তাপশক্তি এবং এই ধরনের ব্যাটারি একসাথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রনিক জিহ্বা : খাবারের সতেজতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নতুন প্রযুক্তি
গবেষণার এই নতুন উদ্ভাবন ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। মঙ্গল গ্রহে দীর্ঘমেয়াদী শক্তির উৎস থাকা মানে সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা যেমন নাসা এবং ইলন মাস্কের স্পেসএক্স ইতিমধ্যেই মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এই ধরনের ব্যাটারি সিস্টেম ব্যবহার করে মঙ্গলে শক্তির চাহিদা মেটানো গেলে এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আরও সহজ হতে পারে। এছাড়া, মঙ্গলে স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই ধরনের শক্তির উৎস অপরিহার্য। বিশেষ করে যখন মঙ্গলে রোভার এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি পরিচালনার প্রয়োজন হয়, তখন এই ব্যাটারিগুলি তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে পারে। এর ফলে মঙ্গলের ওপর আরও গভীর এবং বিস্তারিত গবেষণা করা সম্ভব হবে।
এই গবেষণাটি মঙ্গলের কঠিন পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি উৎপাদনের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কার্বন ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলকে ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করার মাধ্যমে মঙ্গলের জটিল পরিস্থিতিতে শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে মঙ্গল অভিযান এবং মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। শক্তির ঘনত্ব বাড়ানো এবং ব্যাটারির চক্র জীবনকাল বাড়ানোর ফলে মঙ্গলের মতো পরিবেশে গবেষণা পরিচালনা করা আরও সহজ হবে।
ওজনহীন ব্যাটারি প্রযুক্তি উদ্ভাবন যা ইলেকট্রিক যানবাহনের রেঞ্জ বাড়াবে ৭০% পর্যন্ত