চীনের বিজ্ঞানীরা একটি নতুন গবেষণার মাধ্যমে দুই পুরুষ ইঁদুরের জিন ব্যবহার করে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে জন্ম নেওয়া ইঁদুরগুলো পূর্ণবয়স্ক হতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা একই ধরণের গবেষণা করেছিলেন, তবে তাদের পদ্ধতিটি ভিন্ন ছিল। নতুন গবেষণাটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ‘সেল স্টেম সেল’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে শুধু দুটি বাবা থেকে জন্ম নেওয়া ইঁদুরগুলোর বেঁচে থাকার বিষয়টি নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট জিনের কার্যকারিতাও পরীক্ষা করা হয়েছে। এই নির্দিষ্ট জিনগুলোর সমস্যার কারণে মানুষের মধ্যে কিছু জটিল রোগ দেখা দিতে পারে, যেমন অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম।
জাপানের গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ইঁদুরের ত্বকের কোষ সংগ্রহ করে তা স্টেম সেলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এই স্টেম সেল থেকে এমন ডিম্বাণু তৈরি করা হয়, যার মধ্যে দুটি এক্স ক্রোমোজোম ছিল। পরে সেই ডিম্বাণুতে পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাণু প্রতিস্থাপন করা হয় এবং বাচ্চা ইঁদুর জন্মানো সম্ভব হয়।
চীনের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্রথমে তারা স্ত্রী ইঁদুরের ডিম্বাণু থেকে ডিএনএ অপসারণ করেন। এরপর সেই ডিম্বাণুতে পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাণু প্রবেশ করিয়ে বিশেষ ধরনের স্টেম সেল তৈরি করা হয়। পরে সেই স্টেম সেল এবং শুক্রাণু একটি দ্বিতীয় ডিম্বাণুতে প্রবেশ করানো হয়, যা থেকে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং তা থেকে বাচ্চা ইঁদুর জন্ম নেয়।
গবেষকরা এই পদ্ধতিতে ২০টি জিন পরিবর্তন করেন, যা “ইমপ্রিন্টিং জিন” নামে পরিচিত। সাধারণত, সন্তানের শরীরে মা-বাবার থেকে দুটি কপি আসে, তবে একটির কার্যকারিতা বন্ধ থাকে। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই জিনগুলোর কার্যকারিতা পরিবর্তন করে দুটি পুরুষ ইঁদুর থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেন।
পূর্ববর্তী গবেষণায় সাতটি জিন পরিবর্তন করা হলেও জন্ম নেওয়া ইঁদুর বাঁচতে পারেনি। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে বিজ্ঞানীরা ২০টি জিন পরিবর্তন করেন, যার ফলে জন্ম নেওয়া ইঁদুরগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারে। তবে এই ইঁদুরদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন তাদের গড় জীবনকাল স্বাভাবিক ইঁদুরের তুলনায় কম ছিল এবং তারা বন্ধ্যা ছিল।
গবেষকদের মতে, ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করা গেলে অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি শুধু জিনগত গবেষণায় নয়, বরং রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তবে মানবদেহে এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক প্রযুক্তিগত ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা নিরসন করা প্রয়োজন।
এই গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইমপ্রিন্টিং জিনের ভূমিকা সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করা। ইমপ্রিন্টিং জিনের ত্রুটি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এই গবেষণা জিনগত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
এছাড়াও, গবেষণাটি ভবিষ্যতে প্রাণী প্রজনন এবং কৃষিক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীর প্রজনন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করা সম্ভব হতে পারে, যা খাদ্য উৎপাদন ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
যদিও এই গবেষণা সফল হয়েছে, তবে মানবদেহে এটি প্রয়োগের জন্য এখনো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। গবেষকরা বলছেন, এই পদ্ধতির ঝুঁকি ও উপকারিতা সম্পর্কে আরও গবেষণা করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গবেষণা জীববিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি হলেও এটি মানুষের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরিশেষে, চীনা বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা শুধু বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটি বড় উদাহরণ নয়, বরং ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, জিনগত গবেষণা এবং প্রাণী প্রজননের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে। তবে এর নৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
কার-টি (CAR-T) সেল থেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময়ের নতুন সম্ভাবনা