গবেষকদের বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রচেষ্টার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হল নিউরোমরফিক কম্পিউটিং। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা মানুষের মস্তিষ্কের মতো কম্পিউটারের কার্যকারিতা নকল করার চেষ্টা করে। আর এই প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ‘মেমরিস্টর’, যা মস্তিষ্কের নিউরন ও সিন্যাপ্সের ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্যানসাস এবং হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা নিউরোমরফিক কম্পিউটিংয়ে ব্যবহৃত মেমরিস্টর তৈরির জন্য একটি বিশাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, যার ফলে ভবিষ্যতে এআই ও কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটতে পারে।
মেমরিস্টর ও নিউরোমরফিক কম্পিউটিং কী?
মেমরিস্টর হলো এমন এক ধরনের মেমরি রেজিস্টর যা ব্রেনের নিউরন এবং সিন্যাপ্সের কার্যকারিতা নকল করতে সক্ষম। এটি তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। মেমরিস্টর প্রযুক্তি নিউরোমরফিক কম্পিউটিং সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়, যেখানে মস্তিষ্কের মত উচ্চ-গতির ও শক্তি-সাশ্রয়ী প্রক্রিয়াকরণের জন্য এই উপাদানগুলো কাজ করে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে চীন
নিউরোমরফিক কম্পিউটিং এমন একটি কম্পিউটিং পদ্ধতি যা মানব মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীর সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে। মস্তিষ্কের নিউরন এবং সিন্যাপ্সের মতোই, মেমরিস্টরগুলো কম শক্তি ব্যবহার করে এবং উচ্চ গতিতে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। এটি আমাদের বর্তমান কম্পিউটার আর্কিটেকচারের থেকে অনেক বেশি কার্যকর এবং শক্তি-সাশ্রয়ী হতে পারে।
গবেষণা ও উন্নয়নের লক্ষ্য
জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের ‘ফিউচার অফ সেমিকন্ডাক্টর প্রোগ্রাম (FuSe2)’ দ্বারা অর্থায়িত এই গবেষণায় ক্যানসাস এবং হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একত্রে কাজ করছেন। এই প্রকল্পটির জন্য $১.৮ মিলিয়ন অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। গবেষকরা অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে সমন্বয় করা ‘মেমরিস্টর’ তৈরি করতে কাজ করছেন যা নিউরোমরফিক কম্পিউটিংয়ে ব্যবহৃত হবে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুডি উ। তার সাথে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক হার্টউইন পেলার্স এবং হিউস্টনের ফ্রান্সিসকো রোব্লেস। তাদের এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো নিউরোমরফিক কম্পিউটিং সিস্টেমের উন্নয়নের মাধ্যমে ব্রেনের মতো কার্যক্ষমতা সম্পন্ন একটি কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি করা।
কো-ডিজাইন পদ্ধতির প্রয়োগ
গবেষক দলটি কো-ডিজাইন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, যেখানে উপাদানের ডিজাইন, নির্মাণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে অ্যাটমিক স্তরে মেমরিস্টরের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তারা এমন এক ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করছেন যা ব্রেনের নিউরন এবং সিন্যাপ্সের মতো কার্যক্ষমতা সম্পন্ন মেমরিস্টর তৈরি করতে সক্ষম। এই মেমরিস্টরগুলো অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে, যা অ্যাটমিক স্তরে সমন্বয় করা হয়েছে। এই গবেষণা মূলত উপাদানের কার্যকারিতা এবং বৃহৎ পরিসরে সমরূপতার উপর জোর দেয়।
প্রথমবারের মত পূর্ণ-মেকানিক্যাল কিউবিট তৈরি করেছে সুইজারল্যান্ডের গবেষকরা
গ্যালিয়াম অক্সাইড এবং আল্ট্রাথিন মেমরিস্টর
গবেষকরা গ্যালিয়াম অক্সাইডের মতো আল্ট্রা-ওয়াইড ব্যান্ডগ্যাপ সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে আল্ট্রাথিন মেমরিস্টর তৈরি করেছেন, যার পুরুত্ব দুই ন্যানোমিটারের চেয়েও কম। এটি এমন এক ধরনের উদ্ভাবন যা পৃথিবীর অন্য কোনো গবেষক দল করতে পারেনি। অধ্যাপক জুডি উ এবং তার সহযোগীরা এই আল্ট্রাথিন মেমরিস্টর তৈরি করে নতুন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো এমন মেমরিস্টর তৈরি করা যা নিউরোমরফিক সার্কিটে নিউরন ও সিন্যাপ্সের মতো কাজ করতে পারে এবং আমাদের মস্তিষ্কের মতো চিন্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং প্যাটার্ন চিনতে সক্ষম হয়।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
এই গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে, গবেষক দলটি সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করতে শিক্ষামূলক ও আউটরিচ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতি গ্রীষ্মে একটি এক-সপ্তাহের কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে বিশেষ করে অভিবাসী ছাত্রদের উপর গুরুত্ব দেয়া হবে। এই ছাত্ররা সাধারণত শিক্ষাগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় কারণ তাদের পরিবারগুলি কাজের জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এই কর্মশালা তাদের সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোইলেকট্রনিক্স এবং ক্লিনরুম মাইক্রোফ্যাব্রিকেশনের মত উচ্চ প্রযুক্তি ক্ষেত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ
এই কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রের সাথে পরিচিত হতে পারবে এবং ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রে কর্মজীবন গড়ার চিন্তা করতে পারবে। এই গবেষণার সাথে জড়িত অনেক পিএইচডি শিক্ষার্থী বর্তমানে ইন্টেল, হানিওয়েল, টাওয়ার সেমিকন্ডাক্টর, ব্লু অরিজিন, লকহিড মার্টিন, এবং ASM এর মতো কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। গবেষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন, হাতে-কলমে আউটরিচ কার্যক্রমও পরিকল্পনা করছেন, যার মাধ্যমে আরও বড় পরিসরে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে।
নিউরোমরফিক কম্পিউটিং এবং মেমরিস্টর প্রযুক্তির এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে এআই এবং কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। এই প্রযুক্তি আমাদের বর্তমান কম্পিউটার সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি সাশ্রয়ী এবং দ্রুততর হবে। এর মাধ্যমে এমন কম্পিউটিং সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব হবে যা মানুষের মস্তিষ্কের মতো চিন্তা করতে পারে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক জটিল সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবে।
এই গবেষণা শুধু কম্পিউটিং ক্ষেত্রেই নয়, বরং শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এই ধরনের উদ্ভাবন ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং তাদের উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কর্মজীবন গড়ার পথ সুগম করবে।
আরও পড়ুনঃ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় মেমরি স্টোরেজে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন