ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আমরা অনেকেই শুনেছি, কিন্তু এটির প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও গবেষণা করছেন। মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশ মোট কসমসের মাত্র ৫ শতাংশ নিয়ে গঠিত। বাকি ৯৫ শতাংশ এখনও অজানা, যার মধ্যে ২৭ শতাংশ হতে পারে ডার্ক ম্যাটার। বিজ্ঞানীরা এটি খুঁজে বের করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষামূলক গবেষণার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভিজিবল ইউনিভার্সের অর্থাৎ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ, গ্যাস জায়ান্ট, কৃষ্ণগহ্বর, এমনকি আমাদের পৃথিবীসহ সমস্ত কিছুই কসমসের মাত্র ৫ শতাংশ গঠন করে। বাকি অংশের মধ্যে একটি বিশাল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গঠিত। বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারকে শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষায় লিপ্ত রয়েছেন।
ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি প্রস্তাব করা হয়েছে, যা একেবারে ভিন্নধর্মী। এটি কণাবিজ্ঞান বা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের পরিবর্তে প্রাচীন পাথরের মধ্যে লুকানো থাকতে পারে এমন ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব অনুসন্ধান করা। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করছেন যে, পৃথিবীর প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে ডার্ক ম্যাটার হয়তো কোনো না কোনো সময় এর সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করেছে।
আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় কণা অ্যাক্সিয়নের সন্ধান পেয়েছে বিজ্ঞানীরা
ভিরজিনিয়া টেকের নেতৃত্বে একটি বৈজ্ঞানিক দল পৃথিবীর গভীরে লুকানো ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব অনুসন্ধানের চেষ্টা চালাচ্ছে। প্যাট্রিক হাবার নামে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি এই গবেষণায় শুধু তাত্ত্বিক কাজই করেননি, বরং বাস্তবে এটি কিভাবে কার্যকর করা যায়, সেই বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। তাদের এই প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন থেকে ৩.৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং জাতীয় পরমাণু নিরাপত্তা প্রশাসন থেকে ৭.৫ লাখ ডলারের আলাদা অনুদান প্রদান করা হয়েছে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, ডার্ক ম্যাটার পৃথিবীর কেন্দ্রের চারপাশে অদৃশ্য বস্তু হিসেবে অবস্থান করে মহাকর্ষশক্তি তৈরি করছে। এই বস্তুটিকে অদৃশ্য থাকার কারণ হলো এটি শুধুমাত্র খুব দুর্বলভাবে অন্যান্য পদার্থের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এই দুর্বল ইন্টারঅ্যাকশন শনাক্ত করতে, এবং এর প্রমাণ হিসেবে প্রাচীন পাথরের মধ্যে থাকা সম্ভাব্য ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করেছেন।
হাবার তার গবেষণাগারের জন্য পাথরের ভেতরে ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন। তিনি এই গবেষণায় উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ডার্ক ম্যাটারের অনুপস্থিতি এবং উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এই গবেষণায় বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট পাথর বা খনিজ পদার্থকে বিশ্লেষণ করে এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হবে।
প্রথম পর্যায়ে গবেষকরা মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিন্থেটিক লিথিয়াম ফ্লোরাইডের মধ্যে উচ্চ শক্তির কণার ট্র্যাক তৈরি করতে সফল হয়েছেন। তবে লিথিয়াম ফ্লোরাইড প্রকৃত ডার্ক ম্যাটারের জন্য ভালো ডিটেক্টর নয়, কিন্তু এটি অন্য পদার্থের উপস্থিতির বিষয়টি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলটি ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি এবং এটির প্রভাব চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতি অনেকটাই ব্যতিক্রমী, কারণ এটি সাধারণ কণা পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি বাস্তবে প্রাচীন পাথরের মধ্যে থাকা কণার আন্দোলন এবং তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে এই অদৃশ্য পদার্থের বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করছে।
বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে পৃথিবীর ইন্টারঅ্যাকশনের সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ গবেষণা করতে চান। তাদের মতে, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো প্রকারের ইন্টারঅ্যাকশন হয়ে থাকলে, তার প্রভাব প্রাচীন পাথরের মধ্যে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধারণা থেকেই বিজ্ঞানীরা পাথর ব্যবহার করে ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার পরিকল্পনা করছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে আঘাতকারী উল্কাপিন্ডের রহস্যময় উত্স উন্মোচন করেছেন
১৯৮০ সালের দিকে প্রথমবারের মত গবেষকরা প্রস্তাব করেন যে, পৃথিবীর গভীরে থাকা প্রাচীন পাথর ডার্ক ম্যাটারের ইন্টারঅ্যাকশন শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। তবে তখন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি না থাকায় বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিষয়টি নিয়ে আবার কাজ শুরু হয়েছে। হাবার বলেন, যখন তিনি প্রথমবার এই ধারণাটি শুনেছিলেন, তখন তিনি ভাবলেন এটি সম্পূর্ণ পাগলামি। কিন্তু তিনি এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে চান।
এই গবেষণায় বিশেষ ধরণের ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাথরের ক্রিস্টাল গঠন বিশ্লেষণ করা হবে। যদি কোনো উচ্চ শক্তির কণা পাথরের অভ্যন্তরে থাকা নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ করে, তাহলে সেই সংঘর্ষের ফলে নিউক্লিয়াস তার অবস্থান থেকে ছিটকে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া ক্ষুদ্র ধ্বংসের চিহ্নগুলো খুঁজে বের করার জন্য এই ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
গবেষক ভসেভলোদ ইভানোভ বলেন, “আমরা এমন একটি ক্রিস্টাল নিবো যা বিভিন্ন কণার সাথে মিলিয়ন বছর ধরে সংস্পর্শে ছিল এবং তারপরে আমরা সেই সব কণা চিহ্নিত করবো যা আমাদের জানা আছে। যেটি বাকি থাকবে, সেটি কিছু নতুন হতে পারে এবং সেটি হতে পারে ডার্ক ম্যাটার।”
ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার জন্য এই গবেষণা পৃথিবীর গভীরে করা হবে, যাতে অন্যান্য উচ্চ শক্তির কণা যেমন কসমিক রশ্মির প্রভাব কম থাকে। তবে গভীরে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তরে রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থের প্রভাবও দেখা দিতে পারে, যা নিউক্লিয়াসকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক রবার্ট বডনার, যিনি সম্প্রতি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তিনি হাবারের দলের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি এই গবেষণায় উপযুক্ত খনিজ পদার্থের অবস্থান চিহ্নিত এবং সেগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে কাজ করছেন।
এই বিশাল ইমেজিং কাজের শুরুতে, হাবার সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। তারা মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথম ধাপে কণার গতিপথের ৩ডি চিত্র তৈরি করেছেন।
এই গবেষণা থেকে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে, যেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তায় কাজে আসতে পারে। এটি হল লিথিয়াম ফ্লোরাইড ইমেজিং প্রযুক্তি, যা নিউক্লিয়ার ট্রান্সপারেন্সি ডিভাইস তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ধরনের ডিভাইস পরমাণু চুল্লিতে মনিটরিংয়ের জন্য ব্যাকপ্যাকের আকারের ডিভাইস হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এই অনন্য গবেষণার মাধ্যমে ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি এবং এর প্রভাবের আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি আমাদের মহাবিশ্বের গতিবিধি এবং এর বিভিন্ন গঠন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ধারণা দিতে পারে। এটি আমাদের মহাবিশ্বের বাকি ৯৫ শতাংশ সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য উদঘাটনে সহায়ক হতে পারে।
গবেষক হাবার এবং তার দল তাদের এই গবেষণার মাধ্যমে আরও গভীরে যেতে এবং আরও ভালোভাবে বুঝতে চান যে প্রাচীন পাথর কি আমাদেরকে মহাকাশের অজানা রহস্য সম্পর্কে নতুন কিছু বলতে পারে। এই গবেষণা যদি সফল হয়, তাহলে এটি কণা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বিশাল অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর মাধ্যমে তোলা গ্যালাক্সির বৃহত্তম “সুপার স্টার ক্লাস্টার” এর ছবি