১১ বিলিয়ন বছরের মহাকাশ ইতিহাসের তত্ত্ব প্রকাশ করেছে ডিইএসআই (DESI)

ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট (ডিইএসআই) সম্প্রতি মহাবিশ্বের গঠন এবং মহাকর্ষীয় শক্তির প্রভাব নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছে, যা ১১ বিলিয়ন বছরের মহাকাশ ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই গবেষণার মাধ্যমে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রয়োগ মহাকাশের বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা করা হয়েছে। ডিইএসআই প্রায় ৬ মিলিয়ন গ্যালাক্সি এবং কোয়াসার থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্বের গঠন, নিউট্রিনোর ভর এবং ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির বন্টন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।

ডিইএসআই একটি বিশ্বব্যাপী প্রকল্প, যেখানে ৭০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান এবং ৯০০ গবেষক অংশ নিয়েছেন। এই গবেষণাটি লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি দ্বারা সমন্বিত হয়েছে এবং এটি নিশ্চিত করেছে যে মহাকর্ষ আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ীই কাজ করছে। এই গবেষণা বিকল্প মহাকর্ষ তত্ত্বগুলোর ওপর আরও কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে, যা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের মতো কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা পূর্বে ব্যবহার করতেন।

মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা গঠনের ক্ষেত্রে মহাকর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিইএসআই-এর ডেটা ব্যবহার করে একটি বৈপ্লবিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে মহাকর্ষ কীভাবে প্রাথমিক মহাবিশ্বের সামান্য পার্থক্যগুলোকে বড় গ্যালাক্সি ক্লাস্টার এবং মহাকাশের গঠনে রূপান্তরিত করেছে। এই গবেষণায় ডিইএসআই মহাকাশের ১১ বিলিয়ন বছরের গঠনের ইতিহাসকে ম্যাপ করেছে, যা বৃহত্তম পরিসরে মহাকর্ষের সবচেয়ে নির্ভুল পরীক্ষা। ডিইএসআই মহাকাশের বিভিন্ন গ্যালাক্সি ও গঠনকে পর্যবেক্ষণ করে মহাকর্ষের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে। গবেষকরা বিভিন্ন মহাকর্ষ মডেলের সাথে পর্যবেক্ষণ তুলনা করে মহাকাশ পরিসরে মহাকর্ষের পরীক্ষা করেছেন।

আরও পড়ুনঃ ব্ল্যাক হোল এর তাণ্ডব: তারাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে মহাজাগতিক সংঘর্ষের সৃষ্টি

ডিইএসআই-এর মূল লক্ষ্য হলো মহাবিশ্বের গঠনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা এবং মহাকর্ষের প্রভাব নির্ণয় করা। বিভিন্ন মহাকর্ষ মডেল মহাকাশে গ্যালাক্সির ভিন্ন ভিন্ন গঠন পূর্বানুমান করে। ডিইএসআই-এর পর্যবেক্ষণ এবং সিমুলেশন বিশ্লেষণের মাধ্যমে মহাকাশের মহাকর্ষীয় শক্তির সঠিক পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

ডিইএসআই গবেষণায় পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, যা পূর্বে শুধুমাত্র সৌরজগতের পরিসরে পরীক্ষিত ছিল, তা বৃহৎ মহাকাশ পরিসরেও প্রযোজ্য। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানী পলিন জরুক বলেন, গ্যালাক্সির গঠনের হার অধ্যয়ন করে আমরা আমাদের তত্ত্বগুলো সরাসরি পরীক্ষা করতে পারছি এবং এখন পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি তা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাথে মিলে যাচ্ছে।

গবেষণাটি নিউট্রিনোর ভরের ওপরও নতুন সীমা নির্ধারণ করেছে, যা হলো একমাত্র মৌলিক কণা যার ভর এখনো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পূর্বে বিভিন্ন নিউট্রিনো গবেষণায় পাওয়া যায় যে তিন ধরনের নিউট্রিনোর মোট ভর কমপক্ষে ০.০৫৯ eV/c² হওয়া উচিত। ডিইএসআই-এর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এই ভরের পরিমাণ ০.০৭১ eV/c² এর কম হওয়া উচিত। এই সীমা নির্ধারণের ফলে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর প্রকৃতি নিয়ে আরও বেশি গবেষণা করতে সক্ষম হচ্ছেন।

ডিইএসআই গবেষণা গ্যালাক্সির ৩-ডি ম্যাপ তৈরি করেছে, যা মহাবিশ্বের বৃহত্তম ৩-ডি ম্যাপ হিসেবে পরিচিত। এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এই বিশ্লেষণ থেকে ডার্ক এনার্জি নিয়ে কিছু নতুন ধারণাও পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে ডার্ক এনার্জি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। এই নতুন বিশ্লেষণে ডাটা থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য বের করা হয়েছে, যেখানে গ্যালাক্সি এবং পদার্থের স্থানীয় বন্টন নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষকরা কয়েক মাস ধরে এই বিশ্লেষণ চালিয়ে গেছেন এবং ফলাফল পরীক্ষা করেছেন।

ডিইএসআই একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র যা একসাথে ৫,০০০টি গ্যালাক্সির আলো সংগ্রহ করতে সক্ষম। এটি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের নিকোলাস ইউ মায়াল ৪-মিটার টেলিস্কোপে সংযুক্ত রয়েছে। ডিইএসআই বর্তমানে আকাশ পর্যবেক্ষণের চতুর্থ বছরে রয়েছে এবং প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি গ্যালাক্সি এবং কোয়াসার সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ডিইএসআই প্রকল্পের প্রথম তিন বছরের ডেটা বিশ্লেষণ চলমান রয়েছে এবং ২০২৫ সালের বসন্তে ডার্ক এনার্জি এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ইতিহাসের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করার প্রত্যাশা রয়েছে। ডিইএসআই-এর সম্প্রসারিত ফলাফলগুলো পূর্বে প্রকাশিত তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ডার্ক এনার্জির বিকাশের ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের বিশ্লেষণের জন্য আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।

ডার্ক ম্যাটার : পাথরের ভিতর থেকে মহাবিশ্বের অজানা রহস্যের সন্ধান

ডিইএসআই-এর সাহায্যে মহাবিশ্বের বিশাল এবং মূল প্রশ্নগুলো নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। ডিইএসআই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি নিয়ে আরও গভীর গবেষণা করা, যা বর্তমানে মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫% গঠন করে। ডিইএসআই মহাবিশ্বের গঠন এবং এর গঠনকে নির্ণয় করতে সহায়তা করছে। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি আরও বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করা।

এই গবেষণার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের গঠন, সম্প্রসারণ, এবং মহাকর্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও বিস্তারিত ধারণা পেতে সক্ষম হয়েছেন। ডিইএসআই প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী একাধিক প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের গঠন এবং এর সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং ডিইএসআই-এর মাধ্যমে এই বিশ্লেষণ কার্যকরভাবে সম্ভব হচ্ছে। ডিইএসআই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য মহাবিশ্বের গঠন এবং এর সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণা করা, যা আমাদের মহাকাশের গঠন এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও বিশদ ধারণা দেয়।

আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় কণা অ্যাক্সিয়নের সন্ধান পেয়েছে বিজ্ঞানীরা

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো