প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা নিউট্রনের ভেতরের গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন

নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে একটি বড় সাফল্য এসেছে, যেখানে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো নিউট্রনের ভেতরের গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের থমাস জেফারসন ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ফ্যাসিলিটি-তে নতুন সেন্ট্রাল নিউট্রন ডিটেক্টর স্থাপনের মাধ্যমে এ অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। এ অভাবনীয় সাফল্য নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানকে আরও উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিউট্রন এবং প্রোটনকে সম্মিলিতভাবে নিউক্লিয়ন বলা হয়। এগুলো মূলত পদার্থের মৌলিক উপাদান। যদিও এতদিন গবেষণাগারে নিউক্লিয়ন নিয়ে গবেষণার সময় প্রোটনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবার বিজ্ঞানীরা তাদের দৃষ্টি নিউট্রনের দিকে নিবদ্ধ করেছেন। নিউট্রনের অভ্যন্তরীণ স্তরের উপর এই নতুন গবেষণা আমাদেরকে কিভাবে কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন নিউক্লিয়নের সম্পূর্ণ স্পিনের সাথে সম্পর্কিত তা বুঝতে সাহায্য করবে।

নিউট্রন এবং প্রোটনের গঠন

নিউট্রন ও প্রোটন মূলত কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন দ্বারা গঠিত। কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন কীভাবে নিউক্লিয়নের অভ্যন্তরে বিতরণ করা হয় এবং তারা কীভাবে নিউক্লিয়নের স্পিনে ভূমিকা রাখে, বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। এ ব্যাপারে পরীক্ষা চালানোর জন্য গবেষকরা একটি বিশেষ ইলেকট্রন বিম অ্যাক্সিলারেটর ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়নের লক্ষ্যবস্তুতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর কীভাবে নিউক্লিয়ন প্রতিক্রিয়া করে তা বিশ্লেষণ করা হয়।

আরও পড়ুনঃ পদার্থবিদরা সময় পরিমাপের একটি নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছেন

নিউট্রনের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে গবেষণা করা বেশ কঠিন কাজ ছিল, কারণ নিউট্রন সাধারণত প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে যায়, যা গবেষণাগারে মাপা অনেক চ্যালেঞ্জের। এ জন্য ফ্রান্সের সেন্ট্রাল নিউট্রন ডিটেক্টর ডেভেলপমেন্টের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল।

ডিপলি ভার্চুয়াল কম্পটন স্ক্যাটারিং (DVCS)

একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়ার নাম হচ্ছে ডিপলি ভার্চুয়াল কম্পটন স্ক্যাটারিং (DVCS)। এই প্রতিক্রিয়ায় একটি ইলেকট্রন একটি নিউক্লিয়নের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। নিউক্লিয়ন ইলেকট্রনের কিছু শক্তি শোষণ করে এবং একটি ফোটন নির্গত করে। এভাবে নিউক্লিয়ন ভাঙে না, বরং তিনটি কণা দেখা যায় – নিউক্লিয়ন, নির্গত ফোটন এবং ইলেকট্রন। গবেষকরা এই প্রতিক্রিয়াটি অনেকবার বিশ্লেষণ করেছেন। প্রোটনের ক্ষেত্রে এটি বিশ্লেষণ করা সহজ হলেও নিউট্রনের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের ছিল।

কেন্দ্রীয় নিউট্রন ডিটেক্টরটি তৈরি করা হয়েছিল মূলত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য। ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের গবেষণা পরিচালক সিলভিয়া নিকোলাই এবং তার দল ২০১১ সালে এই ডিটেক্টরের নির্মাণ শুরু করেন এবং ২০১৫ সালে এটি সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে এটি ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জেফারসন ল্যাবরেটরিতে ইনস্টল করা হয়।

প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম

২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল নিউট্রন ডিটেক্টরটি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটির মাধ্যমে নিউট্রন পরিমাপের সময় গবেষকরা একটি অপ্রত্যাশিত সমস্যার সম্মুখীন হন, যেটি ছিল প্রোটন কন্টামিনেশন। ডিটেক্টরটি মূলত চার্জযুক্ত কণাগুলোকে বর্জন করার জন্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এতে কিছু ডেড জোন ছিল, যার ফলে প্রোটন অনুপ্রবেশ করতে পারছিল এবং মাপের সময় নিউট্রনের সাথে মিশে যাচ্ছিল।

সৌভাগ্যক্রমে আইজিসিএল্যাবের গবেষক অ্যাডাম হোবার্ট মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধান করেন। তিনি একটি মেশিন লার্নিং ভিত্তিক টুল তৈরি করেন যা ভুয়া সংকেত থেকে আসল নিউট্রনকে আলাদা করতে সাহায্য করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গবেষকরা নিশ্চিত হন যে তারা সঠিকভাবে নিউট্রন পরিমাপ করছেন।

ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পার্থক্য

জিপিডি E এবং নিউক্লিয়নের স্পিন

জেনারেলাইজড পার্টন ডিস্ট্রিবিউশন্স (GPDs) একটি তাত্ত্বিক কাঠামো যা প্রতিক্রিয়া পরিমাপকে নিউক্লিয়নের অভ্যন্তরে পার্টন কণা – যেমন কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের – বিতরণের তথ্য সরবরাহ করতে রূপান্তর করে। GPDs চার ধরনের হয়ে থাকে। এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে কম জানা একটি ধরনের, GPD E, এর তথ্য পেতে সক্ষম হন।

গবেষণায় সিইবিএএফ-এর বিম ব্যবহার করা হয়েছিল যা পোলারাইজড ছিল, অর্থাৎ এর ইলেকট্রনের স্পিন একই দিকে নির্দেশিত ছিল। এটির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা একটি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন যাকে বলা হয় এসিমেট্রি। এই এসিমেট্রি নির্ভর করে বিমের স্পিনের উপর। এর মাধ্যমে তারা অভূতপূর্ব নির্ভুলতার সাথে GPD E নির্ণয় করতে সক্ষম হন। GPD E-এর মাধ্যমে জানা সম্ভব হয় যে নিউক্লিয়নের মোট স্পিনে কোয়ার্ক কিভাবে অবদান রাখে। এটি নিউক্লিয়নের স্পিন স্ট্রাকচার বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এবারের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে নিউট্রনের DVCS পরিমাপ করা সম্ভব। তবে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত পরিমাপের জন্য নতুন করে তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করছেন।

সিলভিয়া নিকোলাইয়ের মতে, এই ফলাফলটি তার গবেষণার একটি বড় অর্জন এবং এর মাধ্যমে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, “এটি আমার ক্যারিয়ারের প্রথম প্রকল্প যেখানে আমি পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম, এবং এই ফলাফলটি পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। এটি একটি জীবনের বড় অর্জনের মতো মনে হচ্ছে।”

চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য জানালো বিজ্ঞানীরা

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো