বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত সমস্যা হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধি। মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে এই গ্যাসের নিঃসরণ এতটাই বেড়েছে যে, এটি পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ানোর মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হলে আমাদের শুধু জ্বালানি ব্যবহার কমানো নয়, বরং এই অতিরিক্ত CO2 বায়ুমণ্ডল থেকে সরিয়েও ফেলতে হবে। তবে বর্তমানের কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি বেশ ব্যয়বহুল এবং শক্তির ব্যবহারও অনেক বেশি। কিন্তু সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যা খুব সহজে পাথরকে CO2 শোষণের যন্ত্রে পরিণত করে।
স্ট্যানফোর্ডের কেমিস্ট মথিউ কানান এবং ইউক্সুয়ান চেন একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন, যেখানে পাথরের মাধ্যমে CO2 শোষণ করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটি সহজ, কম ব্যয়ে এবং কার্যকরী। তাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল, পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ রয়েছে যা CO2 শোষণ করতে সক্ষম, তবে স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়া অনেক ধীর গতিতে ঘটে। এর জন্য তাদের একটি নতুন ধারণা ছিল, যাতে সিলিকেট খনিজগুলোকে আরও দ্রুত CO2 শোষণের উপযোগী করে তোলা যায়।
সিলিকেট খনিজগুলো প্রাকৃতিকভাবে CO2 শোষণ করতে সক্ষম হলেও এটি সাধারণত হাজার হাজার বছর সময় নেয়। তবে কানান এবং চেন একটি নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছেন। তারা সিলিকেট খনিজগুলোকে তাপের সাহায্যে এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন, যাতে এগুলো দ্রুত CO2 শোষণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, সাধারণ সিলিকেট খনিজকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে, যা খুব দ্রুত CO2 শোষণ করতে সক্ষম।
তাদের পদ্ধতির মূল মন্ত্র হল, সিলিকেট খনিজগুলোকে সহজে আয়ন-ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া (ion-exchange reaction) এর মাধ্যমে সক্রিয় করা। এই প্রক্রিয়ায়, পাথরের গঠন পরিবর্তিত হয় এবং তাতে CO2 শোষণের ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে, এই পাথরগুলো দ্রুততার সাথে পরিবেশ থেকে CO2 শোষণ করতে পারে, যা পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী।
এটি কেমন কাজ করে? কানান এবং চেন তাদের গবেষণায় এমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, যা সিমেন্ট তৈরির পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত। সিমেন্ট তৈরির সময় যে কিল্ন বা চুল্লি ব্যবহার করা হয়, তাতে পাথর গরম করে একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া ঘটানো হয়। তারা এই পদ্ধতিটিই ব্যবহার করেছেন, তবে সেখানে বালির পরিবর্তে ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেট ব্যবহার করেছেন। ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেট এমন দুটি খনিজের সমন্বয়ে গঠিত, যা তাপের প্রভাবে সক্রিয় হয়ে দ্রুত CO2 শোষণ করতে পারে।
গবেষণার পরীক্ষায় দেখা গেছে, ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং ক্যালসিয়াম সিলিকেট ব্যবহার করে কিছু সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে CO2 শোষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ, এই খনিজগুলো সিলিকেট খনিজ হিসেবে পরিবেশে দ্রুত পরিণত হয়, যা CO2 শোষণ করতে সক্ষম।
তাদের গবেষণায় একদিকে যেমন পরিবেশগত লাভ রয়েছে, তেমনি কৃষিকাজেও এর উপকারিতা আছে। কৃষকদের জন্য এটি একটি বড় উপকারিতা হতে পারে। বর্তমানে কৃষকরা যখন মাটি খুবই অ্যাসিডিক হয়ে যায়, তখন তারা ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ব্যবহার করেন, যা মাটি এর এসিডিটি কমাতে সহায়তা করে। কিন্তু এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে, ক্যালসিয়াম সিলিকেটের ব্যবহার কৃষকদের জন্য আরও কার্যকর হতে পারে। কারণ ক্যালসিয়াম সিলিকেট মাটির এসিডিটি কমানোর পাশাপাশি সিলিকনও মুক্ত করে, যা গাছপালা শোষণ করতে পারে এবং তাদের উৎপাদন বাড়ায়।
এটি আরও সুবিধাজনক হতে পারে কারণ এটি কার্বন শোষণের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্যও উন্নত করতে সাহায্য করে। এমনকি একটি টন ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং ক্যালসিয়াম সিলিকেট থেকে প্রায় এক টন CO2 শোষণ করা সম্ভব। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রক্রিয়ার জন্য যে শক্তি দরকার, তা অন্যান্য কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির তুলনায় অনেক কম।
তবে এই প্রযুক্তির প্রভাব বিস্তার করতে হলে বিপুল পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং ক্যালসিয়াম সিলিকেটের প্রয়োজন হবে, যা বছরে লাখ লাখ টন হতে পারে। তবে এখানে একটি আশাবাদী দিক হলো, যদি প্রকৃতিতে ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেটের বিপুল পরিমাণ মজুদ থাকে, তাহলে এই প্রযুক্তি পৃথিবীজুড়ে কার্বন শোষণ করতে সক্ষম হবে। এমনকি খনিজ পদার্থগুলি খনি থেকে প্রাপ্ত বর্জ্য পদার্থ থেকেও সংগ্রহ করা যেতে পারে, যা একটি আরও টেকসই সমাধান হতে পারে।
স্ট্যানফোর্ডের গবেষকরা আশা করছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে ধীরে ধীরে এটি একটি বড় আকারে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
এই নতুন প্রযুক্তি তাই শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, কৃষকদের জন্যও একটি বড় সুবিধা হতে পারে। যদি এটি বাস্তবে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে এটি আমাদের কার্বন নিঃসরণের প্রবণতাকে আরও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে এবং কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতাও বাড়াবে। এটি একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, প্রকৃতির নিজস্ব উপাদানকে ব্যবহার করে আমরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।