মানুষের মস্তিষ্ক এবং তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছেন বিজ্ঞানীরা। এই গবেষণার একটি অংশ হিসেবে স্বপ্ন রেকর্ড এবং বিশ্লেষণ করার প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালে জাপানের বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়েছেন যেখানে তারা মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করে স্বপ্নের দৃশ্যগুলো পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রযুক্তিটি মূলত ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এফ.এম.আর.আই-fMRI) এবং মেশিন লার্নিং এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে এটি কোনো সরাসরি ভিডিও বা সিনেমা আকারে স্বপ্নের রেকর্ডিং নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট ক্রমে স্থির চিত্রের মাধ্যমে স্বপ্নের দৃশ্যগুলো প্রদর্শন করে।
স্বপ্ন রেকর্ড করার প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউকিয়াসু কামিতানি এবং তার দল ২০১৩ সালে স্বপ্ন রেকর্ড করার বিষয়ে একটি পরীক্ষা পরিচালনা করেন। এই পরীক্ষায় তারা মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করতে এফ.এম.আর.আই এবং ই.ই.জি প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এফ.এম.আর.আই মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে রক্তপ্রবাহের পরিবর্তন নিরীক্ষণ করে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, ই.ই.জি ব্যবহার করা হয় মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেত পরিমাপ করতে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের প্রথমে বিভিন্ন বস্তু দেখানো হয় যখন তারা জাগ্রত অবস্থায় ছিলেন, এবং তখন তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বে এই প্রথম নন-ইলেকট্রিক টাচপ্যাড তৈরি করেছে ফিনল্যান্ডের গবেষকরা
এরপর, অংশগ্রহণকারীরা ঘুমিয়ে পড়লে এবং তাদের স্বপ্ন দেখা শুরু করলে, ই.ই.জি এর মাধ্যমে সেই স্বপ্নের সময়ের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার পর, অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের স্বপ্নের বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে বলা হয়। এরপর বিজ্ঞানীরা মেশিন লার্নিং মডেলের মাধ্যমে স্বপ্নে দেখা বস্তু এবং জাগ্রত অবস্থায় দেখানো বস্তুগুলোর কার্যকলাপের মিল খোঁজেন। এই প্রক্রিয়াটি প্রায় ২০০ বার পুনরাবৃত্তি করা হয়, যাতে স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর একটি নির্ভুল ধারণা পাওয়া যায়।
স্বপ্নের ভিজ্যুয়াল পুনর্গঠনের পদ্ধতি
বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে একটি নির্দিষ্ট ধরনের আলগোরিদম তৈরি করেন, যা মস্তিষ্কের কার্যকলাপের নিরিখে ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট অনুমান করতে সক্ষম। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট বস্তু দেখানোর সময় যে কার্যকলাপ ঘটে, তা স্বপ্নের সময়ও একই রকম থেকে যায়। ফলে বিজ্ঞানীরা সেই কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে স্বপ্নে দেখা বস্তুগুলোর ছবি পুনর্গঠন করতে সক্ষম হন। তবে এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ ভিডিও নয়, বরং স্থির চিত্রের একটি দ্রুতগামী ক্রম যা স্বপ্নের দৃশ্যকে বোঝায়।
বিজ্ঞানীরা এখন সেই মডেলটি আরও উন্নত করছেন, যাতে তা শুধু নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির ছবি নয় বরং স্বপ্নের অন্যান্য জটিল ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতাও পুনর্গঠন করতে পারে। অধ্যাপক কামিতানি জানিয়েছেন যে বর্তমানে তারা নতুন মডেলটি ঘুমের ডেটা নিয়ে পরীক্ষা করছেন, যাতে তৈরি হওয়া ছবি স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সাথে মিলে যায় কিনা তা যাচাই করা যায়।
স্বপ্ন এবং মানব মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সম্পর্ক
স্বপ্ন দেখা এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক আগ্রহ রয়েছে। মস্তিষ্কে কোনো বস্তুর চিত্র ধারণ করা এবং সেই সময়ের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা স্বপ্নের সময়ও একই থাকে। এভাবে স্বপ্নের বিষয়বস্তু পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের একটি ধারণা পেতে সক্ষম হন।
স্বপ্ন রেকর্ডিং প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
স্বপ্ন রেকর্ডিং প্রযুক্তি শুধুমাত্র স্বপ্নের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য, মানব আচরণ, এবং চেতনার স্বরূপ বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় এই প্রযুক্তি মানসিক সমস্যার নির্ণয় এবং ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে সাহায্য করতে পারে। স্বপ্নের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা এবং আবেগ বোঝার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর মার্ক স্টোকস বলেছেন যে এই গবেষণা আমাদের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে, এবং ভবিষ্যতে হয়তো এমন এক দিন আসবে যখন আমরা স্বপ্নের পুরো চিত্র ভিডিও আকারে দেখতে পাব। তবে বর্তমানে এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ কোয়ান্টাম স্কুইজিং: পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তিতে নির্ভুলতার চাবিকাঠি
বর্তমানে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের বিষয়বস্তু পুনর্গঠন করা সম্ভব হলেও, তা একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখনো স্বপ্নের দৃশ্যগুলো পুরোপুরি বিস্তারিতভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব নয়, এবং বিজ্ঞানীরা স্বপ্নে দেখা স্থান বা পরিস্থিতির সুনির্দিষ্টতা বোঝার চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, স্বপ্নে দেখা একজন মানুষ ঘরের মধ্যে আছে নাকি বাইরে বাগানে আছে, তা এখনো বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে মেশিন লার্নিং এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
যেহেতু এই প্রযুক্তি এখনো উন্নতির পর্যায়ে রয়েছে, তাই ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে আরও নিখুঁতভাবে স্বপ্নের বিষয়বস্তু পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর স্পষ্টতা এবং বিশদতা আরও বাড়বে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, বরং সেই স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন। যেমন, যারা লুসিড ড্রিমিং বা সচেতনভাবে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাদের জন্য এই প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।
স্বপ্ন দেখা মানব মনের একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার পুরোপুরি ব্যাখ্যা এখনো বিজ্ঞানীদের হাতে আসেনি। তবে স্বপ্ন রেকর্ডিং প্রযুক্তি সেই অজানা রহস্য উন্মোচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করছে। মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়, যার মধ্যে একটি বড় অংশ স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে স্বপ্নের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের মনের গভীর চিন্তা এবং অনুভূতি বোঝার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
যদিও স্বপ্ন রেকর্ড করার প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবুও এর উন্নতির মাধ্যমে আমাদের মনের চিন্তা, অনুভূতি এবং আবেগ বোঝার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন, এবং মানসিক সমস্যার নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন, এবং মানসিক সমস্যার নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।