এমআরএনএ চিকিৎসার মাধ্যমে ইনজেকশন ছাড়াই ঔষধ সেবন

বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি নতুন ধাপ হিসেবে ইনহেলেবল এমআরএনএ (mRNA) চিকিৎসা উদ্ভাবিত হয়েছে, যা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ইনজেকশনের ভয়ে অনেকেই চিকিৎসা নিতে দ্বিধা বোধ করেন। তবে ইনহেলেবল এমআরএনএ চিকিৎসা সেই সমস্যার সমাধান আনতে পারে, কারণ এটি ইনজেকশন ছাড়াই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব করে তুলবে। সম্প্রতি জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এমনই এক ইনহেলেবল এমআরএনএ চিকিৎসার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে লিপিড-পলিমার ন্যানোপার্টিকেল, যা নেবুলাইজেশনের সময়ও এমআরএনএ কে স্থিতিশীলভাবে ধরে রাখতে সক্ষম এবং এটি ইঁদুরের ফুসফুসে অ্যারোসোল কণার মাধ্যমে সফলভাবে ডেলিভারি করতে পারে।

এমআরএনএ (mRNA) ডেলিভারির চ্যালেঞ্জ

এমআরএনএ চিকিৎসার মূল কাজ হলো প্রোটিন তৈরি করা, যা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করতে বা প্রতিরোধ করতে সহায়ক। বিশেষ করে ফুসফুসের রোগের ক্ষেত্রে এমআরএনএ চিকিৎসা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে এই প্রোটিনগুলো খুবই ভঙ্গুর এবং স্বতন্ত্রভাবে কোষে প্রবেশ করতে পারে না। এ জন্য এমআরএনএ কে কোষে নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য বিজ্ঞানীরা লিপিড ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করেন, যা একপ্রকার চর্বিযুক্ত কণা, যা এমআরএনএ কে নিরাপদে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

আরও পড়ুনঃ আপনার ইমিউন কোষ (Immune Cells) আপনার ওজন কমাবে

কিন্তু এমআরএনএ কে ইনহেলেশন পদ্ধতিতে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের লিপিড ন্যানোপার্টিকেলগুলো যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল না, কারণ তারা স্প্রে করার সময় একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করত বা আকারে পরিবর্তিত হত। পূর্বে এই সমস্যা সমাধানের জন্য লিপিড কণার সাথে পলিথিলিন গ্লাইকোলের মত পলিমার যোগ করা হয়েছিল, তবে তা নেবুলাইজড ডেলিভারির জন্য পর্যাপ্ত স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি।

নতুন উদ্ভাবন: জুইটারিওনিক পলিমার

গবেষক দলটির নেতৃত্বদানকারী ড্যানিয়েল অ্যান্ডারসন, অ্যালেন জিয়াং, সুশীল লাথওয়াল এবং তাদের সহকর্মীরা ধারণা করেছিলেন যে, ভিন্ন ধরনের পলিমার ব্যবহার করলে হয়তো এমআরএনএ ধারণ করার জন্য লিপিড ন্যানোপার্টিকেলগুলোর স্থিতিশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে। তারা একটি জুইটারিওনিক পলিমার ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন, যা পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জযুক্ত উপাদানগুলোর পুনরাবৃত্তি নিয়ে গঠিত। এই পলিমারটি এমআরএনএ যুক্ত লিপিড ন্যানোপার্টিকেল তৈরি করতে সক্ষম, যা নেবুলাইজেশনের সময়ও স্থিতিশীল থাকতে পারে।

গবেষকরা চারটি উপাদান দিয়ে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেন: একটি ফসফোলিপিড, কোলেস্টেরল, আয়োনাইজেবল লিপিড, এবং বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের লিপিড যা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের জুইটারিওনিক পলিমারের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ লিপিড ন্যানোপার্টিকেল এমআরএনএ কে কার্যকরভাবে ধারণ করতে সক্ষম এবং নেবুলাইজেশনের সময় বা পরে আকার পরিবর্তন করেনি।

প্রাণী পরীক্ষায় কার্যকর ডেলিভারি

প্রাণী পরীক্ষায় দেখা গেছে, কম কোলেস্টেরলযুক্ত জুইটারিওনিক পলিমার সহ লিপিড ন্যানোপার্টিকেলগুলো ছিল অ্যারোসোল ডেলিভারির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এমআরএনএ কোডিং একটি আলোকিত প্রোটিন দিয়ে এই ন্যানোপার্টিকেলগুলো পরীক্ষা করা হলে দেখা যায়, এটি প্রাণীদের ফুসফুসে সর্বোচ্চ মাত্রার আলো বিচ্ছুরণ তৈরি করেছে এবং টিস্যুগুলোতে সমানভাবে প্রোটিনের উপস্থিতি দেখা গেছে। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, এটি এমআরএনএ কে সফলভাবে ফুসফুসে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে।

ইঁদুরকে দুই সপ্তাহ ধরে তিনটি বাতাসে মিশ্রিত ডোজ দেওয়া হয় এবং তাদের ফুসফুসে কোনো ধরনের প্রদাহ দেখা যায়নি। এমনকি সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মতো রোগের মডেল হিসেবে তৈরি করা ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেখানে শ্বাসনালিতে ঘন শ্লেষ্মা থাকে, সেখানেও এই ডেলিভারি পদ্ধতি কার্যকর হয়েছে।

গবেষকরা মনে করছেন, এই ফলাফলগুলো একত্রে প্রমাণ করে যে, জুইটারিওনিক পলিমার সহ লিপিড ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করে এমআরএনএ এর সফল বায়ুবাহিত ডেলিভারি সম্ভব হয়েছে। পরবর্তী ধাপে তারা বড় প্রাণীদের উপর পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছেন, যাতে এই পদ্ধতিটির কার্যকারিতা আরও ভালোভাবে বোঝা যায়।

ইনহেলেবল এমআরএনএ চিকিৎসা ভবিষ্যতে ফুসফুসের রোগের চিকিৎসায় বড় পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শ্বাসকষ্ট, সিস্টিক ফাইব্রোসিস বা অ্যাজমার মতো রোগের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি কার্যকর হতে পারে। এছাড়াও, এটি টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াতেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে, যেখানে ইনজেকশনের বদলে সরাসরি শ্বাসের মাধ্যমে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে। এতে করে যাদের ইনজেকশন নিতে ভয় বা অস্বস্তি রয়েছে, তাদের জন্য এটি একটি বড় সুবিধা হয়ে দাঁড়াবে।

ক্যান্সার রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেল যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা

গবেষণায় ব্যবহৃত এই নতুন ধরনের লিপিড ন্যানোপার্টিকেলগুলো খুবই স্থিতিশীল এবং তা নেবুলাইজেশনের সময়ও আকারে পরিবর্তন হয় না, যা ইনহেলেবল চিকিৎসার জন্য এটি একটি উপযুক্ত পদ্ধতি করে তুলেছে। গবেষকদের মতে, এই উদ্ভাবন ফুসফুসের রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হতে পারে।

এখনও পর্যন্ত এই গবেষণা প্রাণীদের উপর সীমাবদ্ধ, তবে গবেষকরা আশা করছেন ভবিষ্যতে এটি মানুষের উপরেও সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তবে মানবদেহে এর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বড় প্রাণীদের উপর এবং পরবর্তীতে মানুষের উপর আরও গবেষণা প্রয়োজন।

এই গবেষণার অর্থায়ন করেছে ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, সানোফি (পূর্বে ট্রান্সলেট বায়ো), সিস্টিক ফাইব্রোসিস ফাউন্ডেশন, ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অপারচুনিটিস প্রোগ্রাম এবং কোচ ইনস্টিটিউট সাপোর্ট (কোর) গ্রান্ট। গবেষকরা এই প্রযুক্তির উপর পেটেন্ট দাখিল করেছেন এবং তাদের মধ্যে কিছু গবেষক oRNA থেরাপিউটিকস এবং মডার্নার মতো বায়োটেকনোলজি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।

এই গবেষণা দেখিয়েছে যে, এমআরএনএ এর ইনহেলেবল ডেলিভারি সম্ভব এবং এটি ফুসফুসের রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। যদিও এটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তবুও এর সফল প্রয়োগ ভবিষ্যতে ইনজেকশনবিহীন চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তবে আরও গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো