নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে গবেষকরা আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি অবিরাম আলোর খেলা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই আলোর খেলার উৎস হলো স্যাজিটেরিয়াস এ, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। এই ব্ল্যাক হোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্যাস এবং ধূলির একটি ডিস্ক রয়েছে, যাকে অ্যাক্রিশন ডিস্ক বলা হয়। এই ডিস্ক থেকে অবিরামভাবে আলোর ফ্লেয়ার বা বিচ্ছুরণ ঘটছে, যা কখনো ক্ষীণ আবার কখনো তীব্র। এই ফ্লেয়ারগুলো কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এই পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণ ডিস্ক থেকে নির্গত আলো বিভিন্ন আকার ও স্থায়ীত্বের হতে পারে। কিছু আলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়, আবার কিছু আলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি বড় বিস্ফোরণ দেখা যায় এবং এর পাশাপাশি অনেক ছোট আকারের আলোর ঝলকানি ঘটে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, এই আলোর ঝলকানি আকর্ষণ ডিস্কের গভীরে থাকা চৌম্বকীয় পরিবর্তনের কারণে হতে পারে।
স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার থেকে নির্গত আলো মূলত দুই ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। ছোট আকারের ঝলকানি সাধারণত আকর্ষণ ডিস্কের ভেতরে প্লাজমার সংকোচন ও সম্প্রসারণের ফলে হয়, যা ক্ষণস্থায়ী বিকিরণ তৈরি করে। অন্যদিকে, বড় আকারের আলো বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে চৌম্বকীয় পুনঃসংযোগ (Magnetic Reconnection)। এই প্রক্রিয়ায় দুটি চৌম্বক ক্ষেত্র সংস্পর্শে এসে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করে, যা উজ্জ্বল আলোর আকারে প্রকাশিত হয়।
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নির্গমন ক্যামেরা (NIRCam) ব্যবহার করে গবেষকরা ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কৃষ্ণগহ্বরটির পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন। পর্যবেক্ষণের সময় বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আগে নির্গত হয়, আর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কিছুটা পরে আসে। এর কারণ হতে পারে উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন কণাগুলোর ধীরে ধীরে শক্তি হারানো। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশের পদার্থের গতিবিধি সম্পর্কে আরও বিশদ ধারণা লাভ করতে পারবেন।
এই গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশে চলমান ঘটনাগুলোর সময়কাল এবং তাদের প্রকৃতি বোঝার সুযোগ পাওয়া। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার-এর আলো নির্গমনের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা ছন্দ নেই, বরং এটি একেবারেই এলোমেলোভাবে ঘটে। কখনো হঠাৎ একটি উজ্জ্বল আলোক বিস্ফোরণ দেখা যায়, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে তা নিভে যায়।
গবেষকরা আরও লক্ষ্য করেছেন যে, কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশের আলো বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়, এবং এই পরিবর্তনের প্যাটার্ন একেবারেই এলোমেলো। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে, কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশে থাকা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র অত্যন্ত অস্থিতিশীল এবং পরিবর্তনশীল।
এই গবেষণাটি কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতি ও কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিচ্ছে। কৃষ্ণগহ্বর কীভাবে আশেপাশের গ্যাস ও ধুলো সংগ্রহ করে এবং কীভাবে তা বিকিরণ হিসেবে নির্গত হয়, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আরও বিশদ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘসময় ধরে পর্যবেক্ষণ চালানোর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াগুলোর আরও নির্ভুল ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
গবেষকরা আশা করছেন যে, ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ চালানো সম্ভব হলে কৃষ্ণগহ্বরের নির্গমন প্রক্রিয়ার আরও নিখুঁত বিশ্লেষণ করা যাবে। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে একটানা পর্যবেক্ষণ চালানো হলে অনেক ক্ষুদ্র বিবরণও ধরা পড়বে, যা বর্তমান পর্যবেক্ষণে দেখা সম্ভব হয়নি।