রাশিয়ান প্রোগ্রামারের অ্যান্ড্রয়েড ফোনে স্পাইওয়্যার ইনস্টল করেছে এফএসবি

রাশিয়ান প্রোগ্রামার কিরিল পারুবেটস এমন একটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন যা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দাবী, রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে স্পাইওয়্যার ইনস্টল করেছে। ঘটনাটি রাশিয়ার মস্কোতে তার আটক হওয়ার পর ঘটে। নিরাপত্তা গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে তার ফোনে এই স্পাইওয়্যারটি ইনস্টল করা হয়েছিল, যা সম্ভবত ফোনটির শারীরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় ঘটেছে। এই প্রবন্ধে আমরা পারুবেটসের অভিজ্ঞতা, স্পাইওয়্যার ইনস্টলেশনের পদ্ধতি এবং এর পরিণতি নিয়ে আলোচনা করব।

কিরিল পারুবেটসের অভিজ্ঞতা: কিরিল পারুবেটস, যিনি একজন রাশিয়ান সিস্টেম বিশ্লেষক এবং ইউক্রেনীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত, ২০২০ সাল থেকে ইউক্রেনে বসবাস করছেন। তিনি রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর ইউক্রেনীয়দের জন্য আর্থিক ও মানবিক সাহায্য প্রদান করেছেন। তবে, পারুবেটস ও তার স্ত্রী ২০২৩ সালে মস্কোতে ফিরে যান কিছু কাগজপত্রের কাজ সম্পন্ন করতে, কারণ তারা মলডোভিয়ান নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিল, ভোরবেলা এফএসবির ছয়জন এজেন্ট পারুবেটসের মস্কোর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়েন। তারা পারুবেটস এবং তার স্ত্রীকে মেঝেতে ফেলে দেন এবং তাদের ফোনের পাসওয়ার্ড চেয়ে বসেন। ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় পারুবেটস তার ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে বাধ্য হন। এফএসবি সদস্যরা তাদের উপর মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করেন এবং ইউক্রেনে তার অর্থ প্রেরণ কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার ভাইরাস কি? ভাইরাসের নামকরণ করেন কে ও কত সালে? বিস্তারি আলোচনা

স্পাইওয়্যার ইনস্টলেশনের ঘটনা: পারুবেটস এবং তার স্ত্রীকে ১৫ দিনের প্রশাসনিক আটকাদেশ দেওয়া হয়। এই সময়ে, পারুবেটসের ফোনটি এফএসবির নিয়ন্ত্রণে ছিল। মুক্তি পাওয়ার পর, পারুবেটস তার ফোনটি ফেরত পান এবং একটি অদ্ভুত নোটিফিকেশন দেখতে পান: “আর্ম কর্টেক্স vx3 সিঙ্ক্রোনাইজেশন,” যা পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ফোনটি রিবুট হয়। তিনি ফোনটি পরীক্ষা করে একটি সন্দেহজনক অ্যাপ্লিকেশন আবিষ্কার করেন, যা ফোনের বিভিন্ন ব্যক্তিগত ডেটায় প্রবেশাধিকার পেয়েছিল।

বিশ্লেষণ ও প্রমাণ: পারুবেটস “ফার্স্ট ডিপার্টমেন্ট” নামে একটি আইনগত সহায়তা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন। সংস্থাটি কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের কাছে বিষয়টি পাঠায়। গবেষকরা নিশ্চিত করেন যে এই অ্যাপটি একটি ট্রোজানাইজড ভার্সন, যা “কিউব কল রেকর্ডার” নামক একটি বৈধ অ্যাপের মতো দেখায়। তবে, বৈধ অ্যাপটির চেয়ে এটি আরও অনেক বেশি ডেটা অ্যাক্সেস করার ক্ষমতা রাখে। গবেষণায় উঠে আসে যে এই স্পাইওয়্যারটি সম্ভবত “মনোকল” নামের একটি ম্যালওয়্যারের আপডেটেড ভার্সন। ২০১৯ সালে লুকআউট নামে একটি সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা প্রথম মনোকল ম্যালওয়্যার বিশ্লেষণ করে। সেই সময়ে লুকআউট জানিয়েছিল যে এই ম্যালওয়্যারটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের স্পেশাল টেকনোলজি সেন্টার দ্বারা তৈরি, যা রাশিয়ার সরকারি নজরদারি কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছিল।

স্পাইওয়্যারটির কার্যকারিতা: সিটিজেন ল্যাব-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পারুবেটসের ফোনে পাওয়া স্পাইওয়্যারটি ফোনের অবস্থান তথ্য, টেক্সট মেসেজ পাঠানো ও পড়া, স্ক্রিনশট নেওয়া, ভিডিও ক্যামেরা চালু করা, ক্যালেন্ডার পড়া এবং ফোন কল রিসিভ করার মতো বিভিন্ন ক্ষমতা রাখত। এসব ফিচার মূল কিউব কল রেকর্ডার অ্যাপটিতে নেই।

স্পাইওয়্যারটির ঝুঁকি: সিটিজেন ল্যাব-এর গবেষক কুপার কুইন্টিন বলেন, “স্পাইওয়্যার আক্রমণ সবসময় দূর থেকে হওয়ার প্রয়োজন নেই। শারীরিকভাবে ডিভাইসে প্রবেশাধিকার নিয়ে এবং পাসওয়ার্ড আদায় করে এ ধরনের আক্রমণ আরও সহজ হতে পারে।” প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুপার ও তার সহকর্মীরা সতর্ক করেছেন যে যেকোনো ব্যক্তি যার ডিভাইস নিরাপত্তা সংস্থার হাতে গিয়েছে, তাকে সেই ডিভাইস আর বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব: পারুবেটসের এই ঘটনাটি শুধুমাত্র রাশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি উদাহরণ নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাশিয়ার এফএসবির এই কর্মকাণ্ড প্রযুক্তিগত এবং মানবিক উভয় দিক থেকেই গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি বড় সতর্কতা হিসেবে কাজ করবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: সিটিজেন ল্যাব-এর পাশাপাশি ফার্স্ট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার প্রকল্প প্রধান দিমিত্রি জাইর-বেক বলেন, “রাশিয়ার বিশেষ সেবা সংস্থার কর্মকাণ্ড এখন আর কোনো সীমারেখা মানে না। এটি শুধু ইউক্রেনীয় নাগরিকদের জন্য নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের জন্যও একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।”

পারুবেটসের পদক্ষেপ: রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পারুবেটস এবং তার স্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের ফোন মস্কোতেই রেখে দেন, যাতে এফএসবির নজর অন্যদিকে সরানো যায় এবং তাদের কিছুটা সময় বাড়ানো যায়। পারুবেটস বলেন, “আমি মস্কোতেই আছি এমনটা দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। এটি কিছুটা সময় পাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধমূলক কার্যক্রম এর পরিমাণ বাড়ছে

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো